Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বৃষ্টিভাসি চরযদুপুরে বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে কাদায়

ছোট থেকেই মেয়েটা দু’টো শব্দ চিনেছে— ক-এ কীর্তন, ক-এ কাদা। কীর্তনিয়ার মেয়ে সে, নিশিদিন কানে ‘হরিবোল’। আর বর্ষা নামলেই বাড়ির সামনে পথ গলে টায়ার-চেরা কাদা।

বেহাল: চরযদুপুরে রাস্তার এমনই ভয়াবহ দশা। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

বেহাল: চরযদুপুরে রাস্তার এমনই ভয়াবহ দশা। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

শুভাশিস সৈয়দ
বহরমপুর শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৭ ০৩:৫৫
Share: Save:

আশীর্বাদের দিন থেকেই বুক দুরদুর করছিল মেয়েটার। ঠাকুর, বিয়ের দিনটায় যেন বৃষ্টি না হয়!

ছোট থেকেই মেয়েটা দু’টো শব্দ চিনেছে— ক-এ কীর্তন, ক-এ কাদা। কীর্তনিয়ার মেয়ে সে, নিশিদিন কানে ‘হরিবোল’। আর বর্ষা নামলেই বাড়ির সামনে পথ গলে টায়ার-চেরা কাদা।

মেয়ে কবিতাকে বড় যতনে মানুষ করেছেন কীর্তনিয়া অযতন সরকার। বহরমপুর কলেজ থেকে বিএ পাশ দিয়েছে সে। কিন্তু পাত্র জোটানো দায়। কাদা ঠেলে কে আসবে এই চরযদুপুর গাঁয়ে বিয়ে করতে? বৃষ্টি থামলে রাস্তা যা-ও বা রাস্তা শুকোবে, সে এমনই এবড়োখেবড়ো, যেন খাইবার পাস হয়ে কাবুলে চলেছে!

এই তো আশীর্বাদের দিনেই ঘটে গেল কাণ্ডটা। জলঙ্গির সাগরপাড়া থেকে হবু শাশুড়ি-ননদ-জা এসে থমকে দাঁড়ালেন গাঁয়ের মোড়ে। গাড়ি তো আর যাবে না! কী আর করা? চরযদুপুর কালীমন্দিরের কাছে গাড়ি রেখে কাদা মাড়িয়ে তাঁরা কোনও রকমে এসে পৌঁছলেন। বাড়ি ঢুকেই চলকে উঠল ননদের ঝাঁঝ— ‘‘রাস্তার যা অবস্থা, বিয়ের দিন বর কি জুতো হাতে করে কাদা পায়ে ছাদনাতলায় গিয়ে বসবে?’’

বিয়ে বুঝি ভেস্তে যায়-যায়! এ কাণ্ড তো আগেও ঘটেছে এ গাঁয়ে। উত্তরপাড়া বা ব্যারাকপুর থেকে আসা পাত্র ভেগে গিয়েছে খালি কাদা দেখে। গাঁয়ের মদন পান্ডে, তারক সরকার, কার্তিক সরকারের মেয়ের জন্য আসা ভাল পাত্র হাতছাড়া হয়েছে। এ ঘাট-ও ঘাট ঘুরে অবশেষে মনের মতো পাত্র পেয়েছেন অযতন। কীর্তন গায়। শ্বশুর-জামাইয়ে মিলে ঘরোয়া আসর জমিয়ে দেবেন, ভেবেই রেখেছেন। সে বাবাজিও পিছলে না যায়।

অযতন ছুটলেন বহরমপুর ব্লকের রাঙামাটি চাঁদপাড়া পঞ্চায়েতে। হাতে লিখিত আবেদন, রাস্তা সারিয়ে দিতে হবে! পঞ্চায়েত প্রধান মেহেরুন্নেসা বিবি গললেন না। বললেন, বিয়ের আগে রাস্তা সারানো সম্ভব নয়। হাতে টাকা নেই, সভায় কথাও হয়নি।

বিয়ের দিন এসে গেল!

সে দিন সকাল থেকেই আকাশ উপুড় করা বৃষ্টি। কনের ঠাকুর-দেবতা ডাকা সব জলে গিয়েছে। চরযদুপুরের মোড়ে এসে থমকে গেল বরের ফুল-সাজানো গাড়ি। ধুয়ে গিয়েছে রাস্তা, সামনে যদ্দুর দেখা যায়, শুধু থইথই কাদার রকমারি নকশা। গাড়ি থেকে নেমে হতভম্ব জামাই বাবাজি।

ঠিক যেন গাঁয়ের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে ‘সমাপ্তি’র অমূল্য। খানিক হেঁটে গেলেই মৃণ্ময়ীদের বাড়ি। কিন্তু যায় কার সাধ্যি! ছাতা বগলে অমূল্য দু’পা করে হাঁটে আর ধাঁই করে পড়ে। আর তা দেখে আড়াল থেকে ঠিকরে ওঠে মৃণ্ময়ীর হাসি।

জলঙ্গির সাগর দাসকে অবশ্য সেই দুর্বিপাকে পড়তে হয়নি। কাদার বহর দেখে বরযাত্রীরা যখন জুতো-মোজা খুলে প্যান্ট গুটোচ্ছেন, ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন শৌখিন কেউ-কেউ, পাড়ার ছেলেরা বিপত্তারণ হয়ে জামাই বাবাজির গাড়ি ঠেলতে চলে এল। হড়কেই অযতনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেল চারচাকার স্ল‌েজ।

বর যদিও বা এল, পড়শি-কুটুমরা আসবে কী করে? চরমহুলা, যদুপুর, চলহালালপুর, চাঁদপাড়া থেকে কত জনই তো এসে পৌঁছতে পারল না। কত খাবার নষ্ট হল, তার ইয়ত্তা নেই। সে যাক গে, বিয়েটা তো তা-ও ভালয়-ভালয় মিটল!

পরের দিন মেয়ে যখন কান্নাকাটি সেরে ভিজে চোখে শ্বশুরবাড়ি যাবে, ফের কাদার সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে ভেবে সাগর শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে, কবিতার হাত দু’টি ধরে মা রাসমণি বললেন, ‘‘আমার বিয়ের দিনেও খুব বৃষ্টি হয়েছিল, জানিস! এ বাড়ি অবধি হেঁটে আসতে পারিনি প্রথম বার। উনিই সাইকেলের পিছনে বসিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।’’

বলে, ফিক করে হাসলেন। দেখে নিলেন আড়চোখে, খানিক তফাতে হাসছেন কীর্তনিয়াও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Berhampur Road conditio বহরমপুর
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE