সাইকেল - টোটো - মোটরবাইকের ভিড়ে রাস্তায় হাঁটা দায় । থিকথিক করছে শুধু কালো মাথা । ভিড়ের মাঝে কখনও সখনও উঁকি দিচ্ছে লাল-সবুজ-গেরুয়া । কোথাও জোড়াফুল তো কোথাও হাতের হাতছানি ।
বলি হচ্ছেটা কী ? লছিমন থেকে মাথা বের করে বোঝার চেষ্টা করছিলেন এক ব্যক্তি । রাস্তা থেকে উড়ে এল টিপ্পনী — ‘‘মেলা বসেছে গো মেলা। ভোট-মেলা ।’’
মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা । অতএব পাঁজি দেখে এই দিনটাকেই বেছে নিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো । রীতিমতো শুভ সময় দেখে মনোনয়ন জমা দিলেন প্রায় সব দলের প্রার্থীরা । কংগ্রেস, তৃণমূল ও বামদের একাধিক প্রার্থী শ’য়ে শ’য়ে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হাজির হয়েছিলেন রঘুনাথগঞ্জে জঙ্গিপুরের মহকুমা শাসকের দফতরে । আর তাতেই মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার তৃতীয় দিনে কয়েক হাজার দলীয় সমর্থকদের আছড়ে পড়া ভিড়ে কার্যত মেলার চেহারা নিল গোটা চত্বর ।
ভিড় জমতে শুরু করে বেলা ১১টা থেকেই । প্রথম মিছিল করে হাজির হন জঙ্গিপুরের তৃণমূল প্রার্থী জাকির হোসেন । তাতেই মোটামুটি ভরে যায় মাঠের একটা বিরাট এলাকা । মনোনয়ন জমা দেওয়া তো নয়, যেন যুদ্ধ জয়ের মেজাজ। ছোট্ট লরির মধ্যে রাজ্য সরকারের মমতাময় উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে সাজানো ট্যাবলোতে তখন বাজছে রাজনীতির গান ।
জনা কয় সঙ্গীকে নিয়ে অফিসে ঢুকে পড়েন জাকির । বাইরে তখনও সমর্থকদের কানফাটানো স্লোগান । ইতিমধ্যে ম্যাকেঞ্জি স্টেডিয়ামের সামনে সাইকেল-মিছিল নিয়ে পৌঁছে যান রঘুনাথগঞ্জের বিধায়ক আখরুজ্জামান । পথেই দেখা হয়ে যায় সাগরদিঘির সিপিএম প্রার্থী রজব আলির সঙ্গে। মিছিল নিয়ে তিনিও চলেছেন মহকুমা শাসকের অফিসে ।
বাম মিছিলকে পাশ কাটিয়ে মহকুমা শাসকের অফিস লাগোয়া মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়ে হাজার দুই সাইকেল। আগে আগে রঘুনাথগঞ্জের প্রার্থী কংগ্রেসের বিধায়ক আখরুজ্জামান। কংগ্রেসের বিশাল সাইকেল-মিছিল দেখে একটু থমকেই যায় তৃণমূল সমর্থকেরা। ব্যাপারটা বুঝে সুর চড়ায় কংগ্রেসও— “তৃণমূল হটাও, রাজ্য বাঁচাও”। শুনেই তো মেজাজ সপ্তমে, হাজার হোক শাসক দল তারাই। কম কীসে? চেঁচিয়ে উঠল হাজার খানেক গলা— “কংগ্রেস সিপিএম ভাই ভাই, এ রাজ্যে তোদের ঠাঁই নাই”। দু’দলের তুঙ্গে ওঠা স্লোগান-যুদ্ধের মাঝেই টুক করে অফিসে ঢুকে পড়লেন আখরুজ্জামান। মিনিট কুড়ি পেরিয়েছে। সবে একটু স্তিমিত হয়েছে উত্তেজনা। ফের মিছিল উত্তরের গেট দিয়ে। কারা এল রে?
কৌতূহলী চোখ উঁকি ঝুঁকি দিল বাইরের রাস্তায়। প্রায় শ’তিনেক টোটো নিয়ে আসছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী মহম্মদ সোহরাব। মাঝপথেই আটকে দিল পুলিশ। বাধ্য হয়েই পায়ে হেঁটে মিছিল করে ঢুকতে হল অফিস চত্বরে। সে মিছিলে বন্ধু সামশুলকে দেখতে পেয়ে হাঁক পাড়লেন তৃণমূল কর্মী মনসুর।—‘‘লোক কই রে তোদের?” সামশুল কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু হট্টগোলে কানে গেল না কারও।
বেলা পৌনে ২টো নাগাদ ৩৯টা (তৃণমূলের দাবি) গাড়ির কনভয় নিয়ে ঢুকলেন ফরাক্কার তৃণমূল প্রার্থী গোলাম মোস্তাফা। কর্মীদের স্লোগান চড়ল আরও এক ধাপ। এক পক্ষ আওয়াজ তুলছেন “গরু চোর...”, তো অন্য পক্ষের চিৎকার “সারদা আর নারদে, তৃণমূল ঢুকবে গারদে।”
তবে বাইরে কুস্তি চললেও অফিসের ভিতরে কিন্তু ছিল হাসি-ঠাট্টা-মস্করার জমজমাট দোস্তি। মনোনয়ন পত্র দাখিল করে বেরোনোর পথে তৃণমূল প্রার্থী জাকির হোসেনের মুখোমুখি হলেন সিপিএমের জঙ্গিপুরের পুরপ্রধান মোজাহারুল ইসলাম। —“সব ভাল তো।” হাত বাড়িয়ে দিলেন দু’জনেই। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলেন কংগ্রেস বিধায়ক আখরুজ্জামান। দেখা হল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাক্তন বিধায়ক আরএসপির আবুল হাসনাতের সঙ্গে। জড়িয়ে ধরলেন দু’জনে দুজনকে। ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই’ বলে কথা।
এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী ইমানি বিশ্বাস। আবুলকে বিদায় জানিয়ে আখরুজ্জামান এ বার এগিয়ে গেলেন তাঁর দিকে। কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর থেকে একে অন্যকে নিয়ে কুকথার ঝড় বইয়ে দিয়েছেন ইমানি বিশ্বাস। এ দিন কিন্তু সে সব কথা উঠলই না। ‘‘কেমন আছ বন্ধু? বাড়ির সব ভাল তো?’’ বলে হাসি মুখে এগিয়ে গেলেন আখরুজ্জামান। ইমানির বুকে আঁটা ঘাসফুলের প্রতীকটা একটু বেঁকেছিল। সেটাকে সোজা করে দিলেন রঘুনাথগঞ্জের কংগ্রেস প্রার্থী।
পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন এক পুলিশকর্মী। গলাটা নামিয়ে বললেন, ‘‘ভোটের সময় কী হবে জানি না! আজ তো সব ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy