ব্যাটারিচালিত সেই রিকশা। নিজস্ব চিত্র।
কোথাও নাম টোটো। কেউ আবার বলেন টুকটুক। নামে আর কী যায় আসে, যদি সরকারি ছাড়পত্র না মেলে?
অবশেষে বহু আইনি লড়াইয়ের পরে ব্যাটারিচালিত ওই রিকশাকে সড়ক পথে চলাচলের ছাড়পত্র দিল কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের বিভিন্ন আদালতের নিষেধাজ্ঞায় জেরবার হয়ে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মোটর যান আইন ১৯৮৯-এর ১৬তম সংশোধনী এনে শর্ত সাপেক্ষে ব্যাটারিচালিত ওই রিকশাকে মান্যতা দিয়ে ২ অক্টোবর চূড়ান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করল কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক। ওই সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চালক-সহ ৫ জন যাত্রী উঠতে পারবেন ওই রিকশায়। কোনও অবস্থাতেই ২০০০ ওয়াটের বেশি শক্তিসম্পন্ন মোটর ব্যবহার করা যাবে না এই ব্যাটারিচালিত যানে। সর্বোচ্চ গতি হবে ঘন্টায় ২৫ কিলোমিটার। চালককে তিন বছরের জন্য মোটরবাইকের সমতুল্য ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হবে মোটর যান দফতর থেকে। গাড়ির নম্বর ও নিয়মিত ভাবে গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেটও নিতে হবে সেখান থেকেই।
এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর একটি খসড়া বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এ ব্যাপারে জনসাধারণের মতামত চাওয়া হয়। সেই মতো মতামত পাওয়ার পরেই এই চূড়ান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করল কেন্দ্রীয় সরকার। এ বছরের ৭ জানুয়ারি অবশ্য ত্রিপুরা সরকার ব্যাটারিচালিত রিকশাকে সড়কপথে যাত্রী বহনের অধিকার দিয়ে ‘ত্রিপুরা ব্যাটারি অপারেটেড রিকশাস রুল ২০১৪’ চালু করেছে। কেন্দ্রীয় মোটর যান সংশোধনী আইন ২০১৪ চালুর ফলে সারা দেশেই ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল নিয়ে সমস্ত আইনি জটিলতা কেটে গিয়ে ওই রিকশা মান্যতা পাওয়ায় খুশি চালকরা।
সারা দেশের বিভিন্ন শহরে ব্যাটারিচালিত ওই রিকশা চললে চলাচল করলেও এতদিন কোনও সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় ইতিমধ্যেই দিল্লি, কলকাতা-সহ বিভিন্ন হাইকোর্ট ব্যটারিচালিত ওই রিকশায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি বি ডি আহম্মেদ ও সিদ্ধার্থ মৃদুলের ডিভিসন বেঞ্চ গত ৯ সেপ্টেম্বর তাদের সর্বশেষ নির্দেশ জারি করে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, যতদিন না ব্যাটারিচালিত রিকশাকে মোটর যান আইনের পরিধির মধ্যে এনে সেই আইন সংশোধিত না করা হচ্ছে ততদিন ওই রিকশা সড়ক পথে যাত্রী বহনের জন্য চলাচল করতে অনুমতি দেওয়া হবে না। কেন্দ্রীয় সরকার ওই আদালতের কাছে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় চেয়েছিল মোটর যান আইন ১৯৮৯ সংশোধনের জন্য। সরকারের আর্জি ছিল ততদিন পর্যন্ত ওই রিকশা চলাচলে আদালতের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত নির্দেশ স্থগিত রাখা হোক। সে আর্জিও নাকচ করে দেয় দিল্লি হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ। এর ফলেই তড়িঘড়ি তিন সপ্তাহের মধ্যে ব্যাটারিচালিত ওই রিকশাকে অন্তর্ভুক্ত করে কেন্দ্রীয় মোটর যান আইনের ১৬তম সংশোধনী এনে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করল কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক।
এই ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে যখন আদালত ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে এই টানাপড়েন চলছে ঠিক তখনই, ওই রিকশা চলাচলের ক্ষেত্রে ঢালাও ভাবে অনুমতি দিয়ে দিয়েছে রাজ্যের একাধিক পুরসভা। এর জন্য রিকশা মালিকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও জমা নিয়েছে পুরসভাগুলি। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর ও জঙ্গিপুর পুরসভা-সহ রাজ্যের বেশ কয়েকটি পুরসভা নিজেরাই ওই রিকশাকে কীভাবে সড়ক পরিবহনে ছাড়পত্র দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা তুললেন প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। বহরমপুর শহরে এ পর্যন্ত ১১০০ ব্যাটারিচালিত রিকশাকে যাত্রী পরিবহনের ছাড়পত্র দিয়েছে বহরমপুর পুরসভা। পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, “রিকশা প্রতি ১৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে শহরের রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দিয়ে। ৩০০ টাকা করে নিয়ে চালকদের লাইসেন্সও দেওয়া হচ্ছে।” পুরপ্রধানের সাফাই, “রাজ্যের বহু পুরসভা এইভাবে রিকশা চলাচলে অনুমতি দিয়েছে। তাই আমরাও দিয়েছি।” জঙ্গিপুরের পুরপ্রধান মোজাহারুল ইসলাম বলেন, “বহরমপুর পুরসভা দিয়েছে দেখে আমরাও লিখিত অনুমতি দিয়েছি। ১০০০ টাকা করে নিয়ে এই অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবেদন করলেই। সড়কে ব্যাটারিচালিত ওই রিকশা চলাচল আইনসিদ্ধ কিনা সে সম্পর্কে কোনও সরকারি নির্দেশনামা অবশ্য আমাদের কাছে নেই। তাহলে এটা করলেন কীভাবে? সে বিষয়ে অবশ্য কোনও সদুত্তর মেলেনি পুরকর্তৃপক্ষের কাছে।
তবে পুরসভার এই পদক্ষেপকে বেআইনি বলে মনে করছেন আইনজীবীদের একাংশ। সরকারি আইনজীবী অশোক সাহা বলেন, “কোনও পুরসভা এ ধরনের অনুমতি দিতে পারে না। এমনকী মোটর যান আইনের সংশোধন না করে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারও এই অনুমতি দিতে পারে না। দু’চাকার মোটরবাইক চালাতেও যেখানে চালকের লাইসেন্স ও গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করাতে হয় মোটর যান দফতর থেকে, সেখানে ব্যটারিচালিত রিকশার মতো তিন চাকার মোটর যান লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশন ছাড়া রাস্তায় চলার ছাড়পত্র পায় কীভাবে?”
জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “ব্যাটারি চালিত রিকশা নিয়ে আদালতের নির্দেশ ও মোটর যান আইন ১৯৮৯-এর ১৬তম সংশোধনী অনুযায়ী কাজ করবে পুলিশ।” তবে দীর্ঘ আইনি টানাপড়েনের শেষে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন টুকটুকের চালক ও মালিকরা। জঙ্গিপুর মহকুমা ব্যাটারি চালিত রিকশা ইউনিয়নের সম্পাদক সঞ্জীব হালদার বলছেন, “এত দিন পরে রিকশা চলাচলের বাধা কেটে যাওয়ায় সকলেই খুশি। উৎসবের মরসুমে এটাই আমাদের কাছে পাওয়া সব থেকে সেরা উপহার।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy