Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মমতা-স্তুতি নপরাজিতের, থ সব শিবির

একটি সাংবিধানিক সংস্থার শীর্ষে আছেন তিনি। সেই তাঁকেই মাইক হাতে মুখ্যমন্ত্রীর একটি অনুষ্ঠান-মঞ্চের নীচে দেখে বিরোধীরা তো বেমালুম তাজ্জব বটেই! এমনকী হতবাক হয়ে গিয়েছেন তাঁর পূর্বসূরিরাও।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৫ ০৪:৩২
Share: Save:

একটি সাংবিধানিক সংস্থার শীর্ষে আছেন তিনি। সেই তাঁকেই মাইক হাতে মুখ্যমন্ত্রীর একটি অনুষ্ঠান-মঞ্চের নীচে দেখে বিরোধীরা তো বেমালুম তাজ্জব বটেই! এমনকী হতবাক হয়ে গিয়েছেন তাঁর পূর্বসূরিরাও।

তিনি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। বুধবার বর্ধমানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শততম প্রশাসনিক বৈঠকে দাঁড়িয়ে সরকারকে তিনি এমনই দরাজ সার্টিফিকেট দিলেন, যা শুনে রাজ্য প্রশাসনের অনেক তাবড় কর্তাও বিস্মিত।

মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক সম্পর্কে মতামত দেওয়ার জন্য বিশিষ্টজনেদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বর্ধমানে। অধ্যাপক, কবি, ব্যাঙ্ককর্তা ছাড়াও সেই বিশিষ্ট-তালিকায় রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের শীর্ষ পদাধিকারীর নাম দেখে অবাক হয়ে যান অনেকেই। মানবাধিকার কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক সংস্থার দায়িত্বে থাকা কোনও ব্যক্তি এ ভাবে প্রশাসনিক বৈঠকে আসতে পারেন কি না, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তোলার অবকাশ পাননি তাঁরা। তার আগেই সকলকে বিস্মিত করে মাইক হাতে সরকারের প্রশংসায় ‘পঞ্চমুখ’ হয়ে ওঠেন নপরাজিতবাবু। বলেন, ‘‘বাংলার সরকার দারুণ কাজ করছে। যা যা সুপারিশ করছি, সবই মেনে নিচ্ছে।’’

এটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি কমিশনের চেয়ারম্যান। এর পরেও তিনি বলেন, ‘‘আমি আগে এই সরকারের প্রশাসনে ছিলাম। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে আসার পরে দেখছি, এই সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত কোনও অভিযোগই নেই।’’ কমিশন-প্রধান কি প্রশাসনিক বৈঠকে এ ভাবে যোগ দিতে পারেন?

প্রশাসনিক সূত্রের খবর, সরকারের প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কমিশন-প্রধানের এমনিতে মুখোমুখি হওয়ার কথাই নয়। একটি দিন ছাড়া। সেটা হল মানবাধিকার দিবস। সে-দিন কমিশনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই সূত্রে কমিশন-প্রধানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া সরকারি অনুষ্ঠানে ওই দুই শীর্ষ ব্যক্তিত্বের দেখা হওয়ার কথা নয়। কমিশন-প্রধানের তরফে সরকারের পঞ্চমুখ প্রশস্তি গাওয়ার জায়গাই নেই।

কেন নেই, তা ব্যাখ্যা করেছেন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের অনুষ্ঠানে মানবাধিকার কমিশনের তরফে উপস্থিত না-থাকাই বাঞ্ছনীয়। সরকার কেমন কাজ করছে, মানুষের অভিযোগ আছে কি না, সেই বিষয়ে ওঁর (নপরাজিতবাবুর) প্রশস্তি গাওয়াটাও ঠিক হয়নি। কারণ এর সঙ্গে নিরপেক্ষতার প্রশ্ন জড়িত।’’

তীক্ষ্ণ কটাক্ষে বিঁধেছেন কমিশনের আর এক প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘অস্থায়ী চেয়ারম্যান নপরাজিত মুখোপাধ্যায় তো নজির তৈরি করে ফেললেন! মানবাধিকার কমিশনের ২৫ বছরের ইতিহাসে এমন নজির নেই। কমিশন হল স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। নিরপেক্ষতাই তার প্রথম শর্ত। সেখানে উনি এমন দরাজ প্রশংসা করলেন কী ভাবে?’’ অশোকবাবু জানান, কমিশনের কাজ তো মূলত সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ নিয়ে। মানুষ বহু ক্ষেত্রেই সরকারি কর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে কমিশনের দ্বারস্থ হন। ‘‘সেখানে কমিশনের প্রধান যদি সরকারি অনুষ্ঠানে গিয়ে বসে থাকেন, সাধারণের বিশ্বাসের জায়গাটা টাল খেতে বাধ্য,’’ মন্তব্য অশোকবাবুর।

নাম না-করে নপরাজিতবাবুর কাজের সমালোচনা করেছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘‘আমি তো কমিশন। আমি তো সরকার নই। তাই ওই অনুষ্ঠানে আমার থাকার কথা নয়। আমি নিমন্ত্রিতও ছিলাম না। তবে মানবাধিকার কমিশনের অস্থায়ী চেয়ারম্যান কেন গিয়েছিলেন, সেই বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’’

প্রায় দেড় বছর ধরে কমিশনের অস্থায়ী চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন রাজ্য পুলি‌শের প্রাক্তন ডিজি নপরাজিতবাবু। প্রাক্তন ডিজি-কে ওই কমিশনের শীর্ষে বসানোর সময়েই বিরোধীরা সমালোচনা করেছিলেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। সরকার-ঘনিষ্ঠ পুলিশকর্তাকে ওই পদে বসিয়ে কার্যত কমিশনকেই পঙ্গু করে ফেলছে সরকার।

মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে নপরাজিতবাবুর হাজিরা এবং সরকারের উদ্দেশে তাঁর স্তুতিপাঠ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলেই মনে করছেন বিরোধীরা দলের নেতারা। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার এক জন অযোগ্য স্তাবককে ওই পদে বসিয়েছে। ওখানে গিয়ে যে কোনও লাভ হবে না, সেটা বুঝেই মানুষ আর কমিশনমুখো হন না।’’ সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্বে থেকে প্রশাসনের অঙ্গ হওয়া যায় না। ‘‘এ ভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে কমিশনকে সরকারের লেজুড়ে পরিণত করছেন নপরাজিতবাবু,’’ বলেছেন সেলিম। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘নপরাজিতবাবু জনগণের টাকা নিয়ে তৃণমূল নেত্রীর স্তাবকতা করছেন।’’

কী বলছেন নপরাজিতবাবু?

এ দিন বারবার ফোন করেও নপরাজিতবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। মোবাইলে পাঠানো এসএমএসের জবাব দেননি তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE