খাদ্যশস্য প্যাকেজিংয়ে জুট-ব্যাগ ব্যবহারে কাট-ছাঁটের প্রশ্নে কেন্দ্রের ফতোয়া জারির বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে খোদ রাষ্ট্রপতির কাছে দরবার করেছিল রাজ্যের দুই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সাড়া মিলেছে সদ্যই। রাইসিনা হিলসের নির্দেশে কেন্দ্রীয় বস্ত্রবয়ন মন্ত্রক সম্প্রতি চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, চটের ব্যবহারে কেন্দ্রের জারি করা নতুন নিয়ম আপাতত চালু করা হচ্ছে না। সেই সঙ্গে ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরকে ইতিমধ্যেই জুট-বর্ষ হিসেবেও ঘোষণা করেছে তারা।
খাদ্যশস্য প্যাকেজিং প্রসঙ্গে গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রের ওই নয়া ফরমানে বলা হয়েছিল, বাধ্যতামূলক ভাবে ৯০ শতাংশের পরিবর্তে ৭০ শতাংশ জুট-ব্যাগ ব্যবহার করলেই চলবে। চিনির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ জুট-ব্যাগ ব্যবহারের যে ব্যবস্থা চালু ছিল তা না মানলেও চলবে বলে জানানো হয়।
কিন্তু এর ফলে রাজ্যে প্রায় সিকি ভাগ মানুষের জীবিকায় খাঁড়া নেমে আসার আশঙ্কায় বেঁকে বসেছিল রাজ্য সরকার। বস্ত্রবয়ন মন্ত্রকে চিঠি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন তাঁর আপত্তির কথা। পরে তা নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছেও দরবার করা হয়েছিল।
গত ডিসেম্বরের সেই লড়াইয়ে শেষ তক পিছু হটে কেন্দ্রীয় সরকার। বজায় রেখেছিল পুরনো নিদের্শিকাই।
এই ‘জয়’ ফলাও করে প্রচার করে অথর্মন্ত্রী অমিত মিত্রকে চেয়ারম্যান করে মন্ত্রী গোষ্ঠীও গড়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে ওইটুকুই। চার মাস পেরিয়ে গেলেও রাজ্য চটশিল্প প্রসারে কোনও দিশা দিতে পারেনি। কেন্দ্রের তরফেও রাজ্যের চটকলগুলকে চাঙ্গা করার স্পষ্ট উদ্যোগ দেখা যায়নি।
চটশিল্প প্রসারে কেন্দ্র-রাজ্যের উদ্যোগ কি নেহাতই খাতায় কলমে—রাষ্ট্রপতির কাছে এ প্রশ্নই তুলেছিল রাজ্যের দু’টি পরিবেশ সংস্থা।
পক্ষকাল না ঘুরতেই তার উত্তর মিলেছে বস্ত্রমন্ত্রক থেকে। এবং সে জবাবের পিছনে যে রাইসিনা হিলসের নির্দেশ ছিল, চিঠিতে সে কথাও কবুল করছেন ওই মন্ত্রকের এক অধিকর্তা।
ওই চিঠিতে জানানো হয়েছে, রাজ্যে চটশিল্প প্রসারে একটি বিশেষ প্রকল্প গড়েছে বস্ত্রবয়ন মন্ত্রক। জুট টেকনোলজি মিশন বা জেটিএম নামে ওই প্রকল্প পাঁচটি ধাপে চটশিল্পের প্রসারে কাজ শুরু করেছে। সেই সঙ্গে ১৯৮৭ সালের জুট প্যাকেজিং মেটিরিয়ালস (কমপালসারি ইউজ ইন প্যাকেজিং কমোডিটিস)’ আইনও আপাতত বলবৎ থাকছে।
রাজ্যে প্রায় দু’লক্ষ চটকল শ্রমিক রয়েছেন। চটশিল্পের কাঁচামাল পাট চাষের সঙ্গে জড়িতের সংখ্যাও প্রায় ৪০ লক্ষ। চটশিল্পের ক্ষেত্রে ওই নয়া নিয়ম চালু হলে রাজ্যের অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তা বলাই বাহুল্য। ইতিমধ্যে চটের মন্দা বাজারের ছায়া পড়েছে রাজ্যে। চট শ্রমিকদের অবসরকালীন ভাতা থেকে গ্র্যাচুইটি, এমনকী বেতনেও টান পড়েছে। উত্পাদিত সামগ্রীতে গুদাম ভরে উঠলেও বাজারের অভাবে তা বিকোনোর জায়গা নেই।
সহজ সমাধান খুঁজতে অধিকাংশ চটকল মালিক তাই লাগাম টেনে দিয়েছেন উত্পাদনে। আট ঘণ্টার শিফ্ট কোথাও পাঁচ কোথাও বা তিন ঘণ্টায় নেমে এসেছে। ক্রমান্বয়ে এই ছাঁটাই প্রক্রিয়ার মাসুল গুনছেন শ্রমিকরা। এই নিয়ে একটি বেসরকারি সংগঠনের সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, বেশ কিছু চটকলে শ্রমিকদের আয় প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।
দিল্লির মসনদ বদলের পরে, তাই চটশিল্পের হারানো বাজারের করুণ ছবিটা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছিল ওই দুই সংস্থা।
রাজ্যের চটকল শ্রমিকদের বকেয়া গ্র্যাচুইটির প্রশ্নে সাউথ ব্লকের সাড়া পাওয়ায় হুগলির দুই সংস্থা, ‘আইনি সহায়তা কেন্দ্র’ এবং ‘অবসরপ্রাপ্ত জুটমিল শ্রমিক মঞ্চ’ এ বার চিঠি পাঠায় রাষ্ট্রপতির কাছে। তাদের দাবি, যথেচ্ছ প্লাস্টিক বা সিন্থেটিক ব্যাগের ব্যবহার কমিয়ে বস্তা বা চটের ব্যাগের ব্যবহার ফিরিয়ে আনতে হবে।
শ্রম দফতরের দায়িত্ব নেওয়ার পরে চটশিল্পকে চাঙ্গা করতে তাই চটের ‘কোটা’ বা বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকে চিঠি দিয়েছেন মলয় ঘটক। শ্রমমন্ত্রী বলছেন, “ছোট ব্যাগ, পাপোস, কাপের্ট-জুট সামগ্রীতে বৈচিত্র্য এনে বাজার তৈরির একটা চেষ্টা করা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু চটের বস্তার পুরনো বাজার ফিরিয়ে আনতেই হবে। না পারলে চটকল শ্রমিকদের সুদিন ফেরা মুস্কিল।” আর সেই ‘সুদিনের’ খোঁজে মলয়বাবুর অস্ত্র সাতাশ বছর আগের একটি আইন। ১৯৮৭ সালের ওই আইনে চাল-চিনির মতো নানা খাদ্য সামগ্রী চটের বস্তাতেই চালান দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক।
‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ বা হু-এর স্পষ্ট নির্দেশও সে কথাই বলছে। কিন্তু সে নিয়মের তোয়াক্কা করলে তো!
আইনি সহায়তা কেন্দ্রের পক্ষে, বিশ্বজিত্ মুখোপাধ্যায় বলেন, “নিজের নিয়ম নিজেই ভাঙছে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৮৭-র ওই আইনের পরে দেশের অত্যাবশকীয় পণ্যের ৪০ শতাংশই চটের ব্যাগে চালান দেওয়া হত। রাজ্যের চটকলগুলির তখন গড় বাত্সরিক উত্পাদন ছিল প্রায় দেড়-কোটি চটের বস্তা।” কিন্তু দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার চটের ব্যাগের কোটা অর্ধেক কমিয়ে ২০ শতাংশ করে দেয়। ফলে গত কয়েক বছরে চটের বাজার পড়তে থাকে।
এখন প্রশ্ন, পুরনো আইনের ভরসায় ক’দিন টিকে থাকবে চটশিল্প?
কলকাতার একটি পরিচিত বণিক সভার এক কর্তা বলেন, “গত দশ বছর ধরে প্লাস্টিক লবি বা দেশের প্লাস্টিক শিল্পের রমরমা। তাদের ব্রাত্য করে চটের পুনর্জাগরণ কি কেন্দ্রীয় সরকার চাইবে?” সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছে চটকলগুলি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy