Advertisement
E-Paper

সারদা-তথ্য দিচ্ছেন না নিতু, কোর্টে নালিশ সিবিআইয়ের

সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’-এর কুশীলবদের সম্পর্কে যে সব তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল, প্রাথমিক ভাবে তা পেয়েছে সিবিআই। তাই তাঁকে মঙ্গলবার আর নিজেদের হেফাজতে চাইল না তারা। এ দিন ফের জেল হেফাজতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল সুদীপ্তকে। জেরায় সুদীপ্ত যতটা সহযোগিতা করেছেন, ঠিক ততটাই অসহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে ইস্টবেঙ্গল-কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুর বিরুদ্ধে। তিনি তথ্য গোপন করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলে মঙ্গলবার ইস্টবেঙ্গল-কর্তাকে ফের নিজেদের হেফাজতে চাইল সিবিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১১
(বাঁ দিকে) সিবিআই অফিসে দেবব্রত সরকার। (ডান দিকে) আলিপুর আদালত চত্বরে সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়।  নিজস্ব চিত্র

(বাঁ দিকে) সিবিআই অফিসে দেবব্রত সরকার। (ডান দিকে) আলিপুর আদালত চত্বরে সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’-এর কুশীলবদের সম্পর্কে যে সব তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল, প্রাথমিক ভাবে তা পেয়েছে সিবিআই। তাই তাঁকে মঙ্গলবার আর নিজেদের হেফাজতে চাইল না তারা। এ দিন ফের জেল হেফাজতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল সুদীপ্তকে।

জেরায় সুদীপ্ত যতটা সহযোগিতা করেছেন, ঠিক ততটাই অসহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে ইস্টবেঙ্গল-কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুর বিরুদ্ধে। তিনি তথ্য গোপন করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলে মঙ্গলবার ইস্টবেঙ্গল-কর্তাকে ফের নিজেদের হেফাজতে চাইল সিবিআই। এবং আদালত সেই আর্জি মেনে তাঁকে ২৯ অগস্ট পর্যন্ত সিবিআই হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিল। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির অভিযোগ, গত ২০ অগস্ট গ্রেফতার হওয়া ইস্তক নিতু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তদন্তে অসহযোগিতা করছেন। গত কয়েক দিন তাঁকে সুদীপ্তর মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করেছে সিবিআই। দু’জনের দেওয়া তথ্য মিলিয়ে গোয়েন্দাদের দাবি, অনেক ক্ষেত্রেই নিতু তাঁদের ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করছেন।

একই সঙ্গে এ দিন আদালতে একটি নতুন তথ্য পেশ করেছে সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির আইনজীবী আদালতে জানান, আমরিন আরা নামে সারদার এক হিসাবরক্ষক জেরায় বলেছেন, তিনি কয়েকটি পেনড্রাইভ ও সিডি তুলে দিয়েছেন বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশের হাতে। সিবিআইয়ের বক্তব্য, সারদার আর্থিক কেলেঙ্কারির উৎস সন্ধানে ওই সব পেনড্রাইভ ও সিডি-তে মজুত থাকা নথি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে এবং সে জন্য ওইগুলি হাতে পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। সিবিআই সূত্রের খবর, আমরিন আরার ওই জবানবন্দির বিষয়টি এর আগে সামনে এলেও আদালতে কখনও ওই তথ্য এই ভাবে পেশ করা হয়নি। তদন্তকারীদের একাংশ জানান, প্রয়োজনে এই ব্যাপারে বিধাননগর কমিশনারেটের তৎকালীন দু’-এক জন কর্তাকে তলবও করা হতে পারে।

সিবিআই অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হা এ দিন রাতে বলেন, “সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে আমরা যা তথ্য চেয়েছিলাম, পেয়েছি। আপাতত তাঁকে আমাদের আর প্রয়োজন নেই। পরে দরকার হলে সারদা-কর্তাকে ফের হেফাজতে নেব।” সিবিআই সূত্রের খবর, সুদীপ্তকে জেরায় তৃণমূলের প্রথম সারির বেশ কয়েক জন মন্ত্রী, সাংসদের নাম উঠেছে। এর মধ্যে রাজ্যের এক মন্ত্রী, বর্তমান লোকসভার জনা চারেক সাংসদ এবং জনা দুয়েক রাজ্যসভা সদস্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগও পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি তদন্তকারীদের। তা ছাড়া সল্টলেক কমিশনারেটের একাধিক অফিসারের বিরুদ্ধে তথ্য লোপাটের অভিযোগও উঠেছে।

ওই সব নেতা, সাংসদ এবং পুলিশ-কর্তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন, তা জানতে চাওয়া হলে সিবিআই অধিকর্তা বলেন, “অপেক্ষা করুন। ধৈর্য হারাবেন না। রাজনীতিবিদ বা পুলিশ, যাঁরাই এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে আমরা প্রাথমিক ভাবে কোনও প্রমাণ পাব, তাঁদেরই আমরা আমাদের জালে নিয়ে আসব।”

সারদা সংক্রান্ত বিভিন্ন নথি বিধাননগর কমিশনারেট নষ্ট করছে বলে অনেক দিন ধরেই অভিযোগ উঠেছে। গ্রেফতার হওয়া রাজ্যসভা সাংসদ কুণাল ঘোষ এই অভিযোগ আগেও তুলেছেন। সিবিআই সূত্রের খবর, গত বছর এপ্রিলে সুদীপ্ত যখন ফেরার হন, তখন তিনি ভিন্ রাজ্য থেকে আমরিন আরাকে ফোন করে সমস্ত গোপন নথি সরিয়ে দিতে বলেন। আমরিন এতে ভয় পেয়ে যান। তিনি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কাছে যেতে পারেননি। বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ তদন্তে নেমে আমরিন আরার নাম জানতে পারে। পরে সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে আমরিনকে নিয়ে তল্লাশি চালানোর সময়ে ওই সমস্ত পেনড্রাইভ ও সিডি-সহ বিভিন্ন নথির হদিস মেলে। আমরিনই সেগুলি বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশের হাতে তুলে দেন বলে সিবিআই জেনেছে। বিধাননগর কমিশনারেটের এক কর্তা অবশ্য এ দিন বলেন, “আমরা যা বাজেয়াপ্ত করেছি, সেগুলি সবই সিজার লিস্টে রয়েছে।” ঘটনা হল, ওই সমস্ত পেন ড্রাইভ ও সিডি-র উল্লেখ কিন্তু সিজার লিস্টে নেই বলে সিবিআই জেনেছে।

সারদা তদন্তে পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও তদন্তের জাল ক্রমশ গুটিয়ে আনছে সিবিআই। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, কলকাতা ময়দানের একটি ক্লাবের প্রয়াত এক কর্মকর্তার মেয়ে-জামাই থাকেন মুম্বইয়ে। নিতুর সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা তো বটেই, এক রকম পারিবারিক সম্পর্কও রয়েছে বলা চলে। প্রয়াত ক্লাবকর্তার জামাইয়ের ব্যবসার জন্য নিতু তাঁর কাছ থেকে ‘ধমকে-চমকে’ সাত-আট কোটি টাকা আদায় করেছিলেন বলে সিবিআই-কে লেখা চিঠিতে দাবি করেছিলেন সুদীপ্ত। তদন্তে নেমে এই ব্যাপারে কিছু তথ্য সিবিআইয়ের হাতে এসেছে। অথচ নিতুকে বার বার জিজ্ঞেস করা হলেও তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ তদন্তকারীদের।

সিবিআই সূত্রের খবর, তদন্তকারীদের একটি দল প্রয়াত ক্লাবকর্তার জামাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে মুম্বইয়ে পৌঁছেছে। এই প্রসঙ্গে সুদীপ্ত তাঁর চিঠিতে যশ নামে এক অবাঙালি ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করেছিলেন। প্রয়াত ক্লাবকর্তার জামাইয়ের নাম যশ নয়, তবে তার কাছাকাছি। এবং তিনিও অবাঙালি। তদন্তকারীদের একাংশের আশা, নিতু ও প্রয়াত ক্লাবকর্তার জামাইকে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে রহস্যের জট অনেকটাই খুলবে।

সিবিআইয়ের বক্তব্য, সুদীপ্তর থেকে নেওয়া কোটি কোটি টাকার একটি অংশ নিতু চেকে নিয়েছেন এবং একটি সংস্থার নামেই ওই সমস্ত চেক কাটা হয়েছে। ওই সংস্থাটি কী, তার কাজ কী ধরনের, সারদার টাকা নিয়ে সংস্থাটি কী করেছিল, এই নিয়ে নিতু এখনও কার্যত নীরব বলেই গোয়েন্দাদের দাবি। সুদীপ্তর চিঠির সূত্র ধরে এগিয়ে এ ব্যাপারে কিছু তথ্যপ্রমাণ তদন্তকারীরা হাতে পেয়েছেন। সন্ধির অগ্রবাল নামে নিতু-ঘনিষ্ঠ যে ব্যবসায়ীকে ২৩ অগস্ট সিবিআই গ্রেফতার করেছে, তাঁকে জেরা করেও সুদীপ্তর কাছ থেকে নিতুর জবরদস্তি টাকা আদায়ের ব্যাপারে বহু তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে সিবিআইয়ের দাবি।

সারদা মামলায় এ দিন সুদীপ্ত ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়-সহ ছ’জনকে আলিপুর আদালতে হাজির করানো হয়। কুণাল ঘোষ অসুস্থ থাকায় হাজির করা যায়নি বলে পুলিশ সূত্রের খবর। নিতু ছাড়া বাকিদের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন অতিরিক্ত বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট হারাধন মুখোপাধ্যায়।

এ দিন বিধাননগরের সিজিও কমপ্লেক্সে প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ব্যবসায়ী, গৌতম বিশ্বাসকে ডেকে জেরা করে সিবিআই। তদন্তকারীরা জেনেছেন, ওই ব্যক্তিই সুদীপ্ত সেনকে মিডিয়া ব্যবসায় আনেন এবং তাঁর মাধ্যমেই একটি চ্যানেলে মোটা টাকা লগ্নি করেন সারদা-কর্তা। সেটা ২০১০ সালের গোড়ার দিক। তখনও সারদার দু’টি দৈনিক বেরোয়নি। তবে সিবিআইয়ের বক্তব্য, গৌতমকে এ দিন ডাকা হয়েছিল অন্য কারণে।

কী সেটা?

তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, মোহনবাগান ক্লাবের শতবর্ষ উপলক্ষে তৈরি একটি ছবির মিডিয়া পার্টনার ছিল একটি বাংলা দৈনিক। তবে আসলে সুদীপ্ত সেন-ই টাকা ঢেলেছিলেন। গৌতমবাবু ছিলেন ওই ছবির তিন জন প্রযোজকের অন্যতম। এ দিন ঘণ্টাতিনেক জেরার পরে বাইরে এসে গৌতমবাবু দাবি করেন, ওই ছবির চুক্তি ও আয়ব্যয় সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়। একটি ইংরেজি নিউজ চ্যানেলের এক প্রাক্তন সাংবাদিককেও ডেকে পাঠানো হবে বলে এ দিন সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে। সুদীপ্ত তাঁর চিঠিতে জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তির চাপে তিনি এক কোটিরও বেশি টাকা একটি নতুন চ্যানেল করার জন্য ঢেলেছিলেন।

সারদা-তদন্তের অগ্রগতি প্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “যদি সিবিআইকে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে দেওয়া হয়, তা হলে তৃণমূলের পলিটব্যুরোকে আগামী দিনে জেলে রাজনীতি করতে হবে!” তাঁর বক্তব্য, এমন অনেককে সিবিআই ডাকছে বা জিজ্ঞাসাবাদ করছে, যাঁদের শ্যামল সেন কমিশন ডাকেনি। রাজ্য প্রশাসনের সিটও প্রতি পদে অসহযোগিতা করেছিল। এর পরেও সিবিআই যে ভাবে এগোচ্ছে, তাতে আশা হারানোর কিছু নেই বলে অধীর মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত বলেন, “সিটের সঙ্গে সিবিআই তদন্তের গুণগত তফাৎ দেখা যাচ্ছে। তদন্তের গতি এবং ব্যাপকতা আগের চেয়ে বেশি। আমরা চাই, দ্রুত তদন্ত শেষ হোক। টাকা সরানোর সুযোগ কেউ যাতে বেশি না পায়।”

nitu debabrata sarkar saradha scam cbi sudipto sen debjani
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy