সবুজ কমছে শহরে। ক্রমেই বাড়ছে কংক্রিটের জঙ্গল। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
সিটি সেন্টারে আর দেখা যায় না। কিন্তু দেখা যায় বিধান রোডের একটি বাণিজ্যিক ভবনে। তিন বছরেও অদৃশ্য হয়নি দেওয়ালের ফাটল।
দু’বছর আগের ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি এখনও হাড়ের ভিতর টের পান শিলিগুড়ির বাসিন্দারা। সেই সন্ধ্যায় শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা বিপর্যস্ত হয়েছিল। প্রাণ হারিয়েছিলেন এক জন। জখমের সংখ্যা ছিল অনেক। কয়েক হাজার ফ্ল্যাটবাড়িতে ফাটল ধরেছিল। একাধিক উপনগরীর বাণিজ্যিক এলাকায় বড় মাপের ফাটলও দেখা গিয়েছিল। পুরসভা, প্রশাসনের ইঞ্জিনিয়াররা অতি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে অবস্থা সামলেছিলেন। পরিবেশ আন্দোলনও লাগাতার সরব হওয়ায় শহরকে নিরাপদ করতে নানা কর্মসূচি শুরু হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সে সব থিতিয়ে গিয়েছে। শহরে ফের বেআইনি বহুতল তৈরির হিড়িক পড়েছে। শহরের বহু পাড়ায় ফাঁঁকা জায়গা মেলাই ভার। পুরনো বাড়ি থাকলেই তা ভেঙে সেখানে গজিয়ে উঠছে চার-পাঁচ তলা অট্টালিকা। শহরের মধ্যে জায়গা ক্রমশ কমতে থাকায়, যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। শহর ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের গ্রামের দিকে। ইতিমধ্যেই মহানন্দা পেরিয়ে চাঁদমণি চা বাগানের জায়গায় গড়ে উঠেছে বিশাল উপনগরী ‘উত্তরায়ণ’। আরও এগিয়ে এখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া এলাকায় শুরু হয়েছে দ্বিতীয় উত্তরায়ণ তৈরির প্রক্রিয়া। দার্জিলিঙের রাস্তায় পঞ্চনই এলাকায় বহুতলের আড়ালে ঢাকা পড়েছে পাহাড়। হালে পঞ্চনইয়ের ধারে একটি রিসর্টের জায়গায় মাথা তুলেছে সারি সারি অট্টালিকা। কংক্রিটের আড়ালে ঢাকা পড়েছে কার্শিয়াঙের পাহাড়।
জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে শিলিগুড়ি বাড়ছে। কিন্তু বাড়তে গিয়ে কোথাও পাহাড়ি ঝোরা বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার কোথাও নদীর গতিপথকে বাঁধ দিয়ে বদলে ফেলা হচ্ছে। কোথাও নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এমন নানা অভিযোগ সামনে রেখেই উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে পরিবেশপ্রেমীদের। শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে গোঁসাইপুর এলাকায় পাহাড়ি ঝোরা বোজানোর খবর পেয়ে কলকাতা থেকে গিয়ে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখেছেন পরিবেশপ্রেমী সুভাষ দত্ত। তাঁর কথায়, “শিলিগুড়িতে বহুতল প্রয়োজন। কিন্তু পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে তা করতে হবে। সে দিকে খেয়াল না রাখলে ভবিষ্যতে নানা ধরনের সমস্যা বাড়বে।”
অথচ এই শহরেরই একেবারে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলত বৈকুণ্ঠপুরের ঘন জঙ্গল। সাবেক শিলিগুড়ি টাউন থেকে দু’কিলোমিটার হাঁটলেই শাল-সেগুন-আমলকি-হরিতকির বনে কত পাখির আনাগোনা। ইতিউতি বনফুলের ঝোপ। বর্ষা ছাড়া সারা বছর সাহু, জোড়াপানি, করতোয়া, মহানন্দা, ফুলেশ্বরীতে দেখা যেত স্বচ্ছ জল। চিকচিক করত সাদা বালি। তখনও বাঘাযতীন পার্ক ছিল সবুজ ঘাসে মোড়া। তিলক ময়দানও ছিল আরও অনেক বেশি খোলামেলা। শহরে বেশির ভাগই ছিল কাঠের বাড়ি। মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিশুদ্ধ নির্মল বাতাস, নিরিবিলি ও শান্তিপূর্ণ জীবন কাটানোর অন্যতম ঠিকানা যেন ছিল শিলিগুড়ি।
এখন সে সব ইতিহাস। মফস্সল-গন্ধী শিলিগুড়ি ক্রমশ বড় শহর হয়ে উঠেছে। এখন তাকে স্মার্ট সিটি করার পরিকল্পনাও চলছে। কিন্তু আধুনিক হতে হলে দূষিত হতে হবে কেন, উঠছে সেই প্রশ্ন। এক সময়ের শান্তির শহর শিলিগুড়ি এখন শব্দ দূষণ, জল দূষণ, নদী দূষণের জন্যও পরিচিত হয়ে উঠছে, এমনটাই মনে করছেন অনিমেষ বসুর মতো পরিবেশ গবেষকদের অনেকেই।
তবে তাঁরা এটাও মানছেন, সাবেকি ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে থাকলে একটা শহর এগোতে পারে না। তাই শিলিগুড়ির আধুনিক হওয়ার যাত্রাকে স্বাগত জানাতে আপত্তি নেই নাগরিকদের। শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স আর আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়ির আবাসন তৈরি হচ্ছে। এক প্রান্তের চম্পাসারি থেকে অন্য প্রান্তের শক্তিগড়, পূবের ইস্টার্ন বাইপাস থেকে পশ্চিমে মাটিগাড়া লাগোয়া শিলিগুড়ি জংশন এলাকা, সর্বত্রই ফ্ল্যাটবাড়ির ছড়াছড়ি। তাতেও ঠাঁই নেই অবস্থা।
কিন্তু বেপরোয়া সিটির অটোর দৌরাত্ম্য রোজই বাড়ছে। বিধি তোয়াক্কা না করে রোজই যথেচ্ছ শব্দ দূষণ হচ্ছে। একটা শহর যখন মহানগর হওয়ার দিকে এগোচ্ছে, সেই সময়ে দূষণের বাড়বাড়ন্ত কেন এত হবে? এই প্রশ্ন ভাবাচ্ছে সচেতন শহরবাসীদের অনেককেই।
কী ধরনের বিপদ হতে পারে তার আঁচও মিলেছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রধান তথা পরিবেশ বিজ্ঞানী সুবীর সরকারের কথায়, “পাহাড়ের পাদদেশের শহর বলেই শিলিগুড়িতে কোনও নির্মাণ কাজের ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা জরুরি। মনে রাখতে হবে, অতীতে তিস্তা একাধিকবার গতিপথ পাল্টেছে। পঞ্চনইয়ের মতো ছোট নদীও সুদূর অতীতে গতিপথ পাল্টে ভয়ঙ্কর হয়েছিল। তা ছাড়া ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় যথেচ্ছ নির্মাণ বিপজ্জনকও হতে পারে।”
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy