Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বিয়ের কার্ড নিয়েও ব্যাঙ্ক থেকে মিলল মাত্র হাজার

হাতে করে কার্ড নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কে চেয়েছিলেন ৫০ হাজার, শনিবার পেয়েছেন মাত্র এক হাজার। মাঝে রবিবার ব্যাঙ্ক বন্ধ। আজ সোমবার মেয়ের বিয়ে।

জলপাইগুড়িতে এটিএমের সামনেই কাটল রবিবার। নিজস্ব চিত্র।

জলপাইগুড়িতে এটিএমের সামনেই কাটল রবিবার। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:১৭
Share: Save:

হাতে করে কার্ড নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কে চেয়েছিলেন ৫০ হাজার, শনিবার পেয়েছেন মাত্র এক হাজার। মাঝে রবিবার ব্যাঙ্ক বন্ধ। আজ সোমবার মেয়ের বিয়ে।

টাকা ছাড়া কী করে বিয়ে পার করবেন, তা চিন্তা করতে গিয়ে শনিবার রাত থেকে শুধুই কেঁদেই চলেছেন মানিকচকের ভূতনির নবদ্বীপটোলার কন্যাদায়গ্রস্ত জীতেন মণ্ডল। শেষমেষ, খুচরো টাকা সংগ্রহ করে রবিবার সকাল থেকে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি হাত পাতলেন। কিন্তু গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই এখন কপর্দকশূন্য।

তাই ধার হিসেবে কেউ সামান্য কিছু টাকা দিলেন, আবার কেউ ফিরিয়েও দিলেন। দুপুরের দিকে জীতেনবাবুর কাছে জুটল সাকূল্যে ১৪ হাজার টাকা। তিনি বললেন, ‘‘কাল আবার ব্যাঙ্কের গিয়ে ম্যানেজারের একেবারে পায়েই পড়ে যাব। দেখি কিছু পাই কি না। না হলে পড়শিদের এই ধারের টাকাতেই কোনওরকমে নমো নমো করেই বিয়ে সারা হবে।’’ তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে ভূতনিরই হীরান্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের হরচন্দ্রপুর শাখায়।

এক পড়শি সোমেনচন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘‘আমাদেরও অবস্থা জীতেনবাবুর মতোই. ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পড়ে রয়েছে। কিন্তু তুলতে গেলে এক হাজারের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদেরও তো সংসার চালাতে হবে। জীতেনবাবুর এই শিরে সংক্রান্তি অবস্থায় সেই টাকা থেকেই কিছু সাহায্য করতে হয়েছে।

এ দিকে একই দুর্ভোগে পড়েছেন দক্ষিণ চণ্ডীপুর বাল্লিটোলার হরেন মণ্ডলেরও। তাঁরও আজ সোমবার মেয়ের বিয়ে। তিনি ব্যাঙ্কে চেয়েছিলেন ২০ হাজার, পেয়েছেন ৫ হাজার। তিনিও পড়শিদের কাছে হাত পেতেছেন। এ দিকে ২৫ তারিখ পুলিনটোলার দীনেশ মণ্ডলের মেয়ের বিয়ে। তিনি শনিবার ব্যাঙ্ক থেকে ৩ হাজার পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বলেছেন মঙ্গলবার আরও তিন হাজার দেবেন। কিন্তু মাত্র ৬ হাজারে কি বিয়ে পার হয়! তবুও সেই ভরসাতেই বসে রয়েছি।’’ মালদহের ব্যাঙ্ক সমূহের লিড ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার রবীন্দ্রনাথ শর্মা বলেন, ‘‘খুচরো টাকার সমস্যা থাকাতেই ব্যাঙ্কগুলি গ্রাহকদের দাবি অনুযায়ী টাকা সরবরাহ করতে পারছে না। বিয়ে বাড়ির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে।’’

বিয়ের আগেরও দিনও জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার ফুরসৎ নেই। জেন্টস পার্লারে যাওয়া তো দূর অস্ত্্। সকাল থেকেই কখনও বন্ধুদের বাড়ি ছোটাছুটি। কখনও আবার বন্ধুদের মোবাইলে ফোন করে খোঁজ নেওয়া, ‘‘তা হলে কতটা দিতে পারবি বল।’’

দিনের শেষে যা হিসেব দাঁড়াল তাতেও বৌ ভাতের আয়োজন নিয়ে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

আজ সোমবার তাই টাকার সংস্থানের চিন্তা মাথায় নিয়ে বিয়ের ছাদনাতলায় বসবেন বক্সিরহাটের বাসিন্দা শ্যাম কর্মকার। এ দিন তুফানগঞ্জের বাসিন্দা সন্তোষ সাহার মেয়েরও বিয়ের অনুষ্ঠান। ব্যাঙ্কের দোরে দোরে ঘুরে হতাশ কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার ভরসা এখন শুভানুধ্যায়ী বন্ধু, পরিজনেরা। ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজনের বদলে বাজেট কমিয়েও তার উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট।

শুধু ওই দু’জন কিংবা তার পরিজনেরা নয়, একশো ও পাঁচশো টাকার নোট বাতিলের জেরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়েছে জেলার অসংখ্য পরিবার। বিয়ের দিন যত এগোচ্ছে ততই বাড়ছে উদ্বেগ। পরিস্থিতির জেরে হবু পাত্রীরা বিউটি পার্লারে জীবনের অন্যতম স্বপ্নের দিনের জন্য তৈরি হওয়ার কথা ভুলে ব্যাঙ্কে দরবার করছেন। তারপরেও অবশ্য স্পষ্ট কোন আশ্বাস মিলছেনা। টিভিতে বিয়ের জন্য আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া যাবে শুনে আশার আলো দেখেছিলেন যারা, ব্যাঙ্ককর্তারা ‘ অর্ডার’ আসেনি জানানয় হতাশ তারাও। সব মিলিয়ে কেউ হাঁটছেন পুরো আয়োজনের বাজেট কাটছাটের রাস্তায়, অনেকে মেনু কমিয়ে দিচ্ছেন। তাতেও শেষ রক্ষা হবে কি! চিন্তা থাকছেই।

বক্সিরহাটের বাসিন্দা শ্যামবাবু পেশায় ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, “ বিয়ে মানে জীবনের সেরা স্মৃতি। অনেক আনন্দ, স্বপ্ন জড়ান। নোটের নাকাল দশা সব ভুলিয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠান আমার কাছে টাকা জোগাড়ের চিন্তার স্মৃতি হয়ে থাকবে।”

ওই প্রসঙ্গেই হবু পাত্রের সংযোজন, ‘‘ব্যাঙ্কে অনেকবার গিয়েও দুটি আক্যাউন্ট থেকে সাকুল্যে তিরিশ হাজার টাকা পেয়েছি। মেনু, বৌভাতের নিমন্ত্রিত কমিয়েও যা বাজেট দাঁড়াচ্ছে তাতে কুলোচ্ছে না। রবিবারেও টাকা জোগাড়ের চেষ্টায় দিন কাটল।’’ তিনি জানান, হবু স্ত্রীর বাড়িতেও জানিয়ে দিয়েছেন, বরযাত্রীর সংখ্যা অর্ধেক কমাচ্ছেন তিনি।

বিয়ের কার্ড নিয়ে ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে দরবার করে হতাশ সন্তোষ সাহার অভিজ্ঞতাও একই রকম তিক্ত। তিনি বলেন, “টিভির ঘোষণা আর বাস্তবের মিল নেই। একাধিক ব্যাঙ্কে বারবার ছোটাছুটি করে দু’টি আক্যাউন্ট মিলিয়ে পেয়েছি মাত্র ৩৪ হাজার টাকা। ওতে আর কী কুলোয়। আত্মীয়, বন্ধু, পরিজনেরা ভরসা দিচ্ছেন।”

কোচবিহারের বাসিন্দা দেবাশিস চন্দও চিন্তায় রয়েছেন। আগামী ২৫ নভেম্বর তার বোনের বিয়ে। দেবাশিসবাবু বলেন, “কার্ড নিয়ে দরবার করে শুনছি আড়াই লাখের অর্ডার আসেনি। ফুল সহ বিভিন্ন কাজে চেক নিতে চাইছেনা অনেকে। কি যে হবে!” ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর, জেলায় বিভিন্ন ব্যাঙ্কের দুই শতাধিক শাখাতেই বিয়ের জন্য টাকা তোলার খোঁজ নিতে অনেকেই আসছেন।

খাগরাবাড়ির একটি ব্যাঙ্কের কর্তা জানান, ইতিমধ্যে ৫ জন দরবার করেছেন। এক হবু পাত্রী নিজেও হাজির হয়েছেন। কোচবিহারের লিড ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সঞ্জয় কুমার বলেন, “সমস্যাটা বুঝছি। কিন্তু ওই ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশিকা এখনও আসেনি।” আপাতত ওই ‘নির্দেশে’র অপেক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

demonetisation commoners
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE