Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Illegal Mining in Teesta river

তিস্তাপারে রেল সুড়ঙ্গের জটিল ধাঁধা মেলানো কঠিন! বনমন্ত্রীর সই নেই, অথচ সবই নাকি ‘বৈধ’

রেল প্রকল্পের জন্য নদীর গতিপথ আটকে সেতু এবং ক্রাশার নির্মাণকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলে দাবি করে রেল মন্ত্রকে অভিযোগ করেছেন দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তা।

রাজু বিস্তা এবং জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।

রাজু বিস্তা এবং জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।

পার্থপ্রতিম দাস
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২২ ১৮:৩৮
Share: Save:

সেবক থেকে রংপো পর্যন্ত রেলপথের জন্য সুড়ঙ্গ বানানো হবে। সে জন্য শিলিগুড়ি সংলগ্ন সেবকের কাছে তিস্তা ও নন্দীঝোরা আটকে তৈরি করা হয়েছে সেতু। নদীর মধ্যেই বসানো হয়েছে পাথর গুঁড়ো করার যন্ত্র (ক্রাশার)। আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন নদী বিশেষজ্ঞ থেকে পরিবেশবিদ, এমনকি স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাঁদের আশঙ্কা, এতে নদীর গতিপথ পাল্টে যেতে পারে। প্রভাব পড়তে পারে বাস্তুতন্ত্রেও।

রেল মন্ত্রকের কাছ থেকে ওই প্রকল্পের বরাত পাওয়া সংস্থা ‘ইরকন’-এর দাবি, এই অনুমতি দিয়েছে রাজ্যের বন দফতর। অথচ, রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জানিয়েছেন, এমন কোনও ফাইলে তিনি সই করেননি। তা হলে অনুমতি দিল কে? কী ভাবেই বা করা হচ্ছে এই কাজ? তা নিয়েও ধন্দ তৈরি হয়েছে।

শিলিগুড়ির সেবক রোড ধরে দোমাইল পেরোলেই ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক। ওই পথ ধরে মহানন্দা অভয়ারণ্যের মাঝখান দিয়ে সেবকের দিকে যাওয়ার পথে সে রকমই একটি জনপদ তিস্তাবাজার। তারই কাছে তিস্তা নদীর উপর সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। বসানো হয়েছে ‘ক্রাশার’। সিকিমের পথে রেল সুড়ঙ্গ তৈরির কাজে মাটি এবং পাথরের জোগান দেবে ওই ‘ক্রাশার’।

এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, তিস্তার পারে দূর দূর পর্যন্ত পাথরের স্তূপ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ছোটবড় পাথরের চাঁই। প্রশ্ন উঠছে, এ ভাবে কি নদীর গতিপথ আটকে সেতু বানানো বা ক্রাশার বসানো যায়? ঘটনাচক্রে, নদীর গতিপথে সেতু এবং ক্রাশার বসানোকে ‘সম্পূর্ণ অবৈধ’ বলে দাবি করে রেল মন্ত্রকে অভিযোগ জানিয়েছেন দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তা। ঘটনাচক্রে, যে রেল মন্ত্রক তাঁরই দল বিজেপির অধীন। বিস্তা চিঠি দিয়েছেন ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল এবং জিটিএ-তেও। তাঁর কথায়, ‘‘রেল আর যে-ই হোক, নদীর উপর এ ভাবে ক্রাশার বসানো সম্পূর্ণ অবৈধ। এর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’’

যে সংস্থার ক্রাশার বসেছে নদীতে, তার মালিক রতন গর্গের অবশ্য দাবি, টেন্ডার ডেকেই সব কাজ হচ্ছে। ‘ইরকন’ই ক্রাশার বসানোর অনুমতি দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘ইরকনের কাছে যাবতীয় কাগজপত্র আছে। কিছুই অবৈধ নয়। টেন্ডার পেয়েই ক্রাশার বসিয়েছি। ইরকন আমায় অনুমতি দিয়েছে। তাই যা বলার, তারাই বলবে।’’ ইরকনেরও দাবি, সব বৈধ। নিয়ম মেনে বন দফতরের অনুমতিতেই যাবতীয় কাজ হচ্ছে। সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার এপি সিংহের বক্তব্য, ‘‘অনুমতির সব কাগজ রয়েছে। বন দফতরই অনুমতি দিয়েছে।’’

কিন্তু বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় এমন কোনও বিষয়ের কথা মানতে নারাজ। তাঁর স্পষ্ট জবাব, ‘‘আমি এমন কোনও ফাইলে সই করিনি।’’ বনমন্ত্রী যদি কোনও ফাইলে সই করে না থাকেন, তা হলে ‘বৈধ’ কাগজপত্র মিলল কোথা থেকে? সরকারি সূত্রের দাবি, নিয়ম অনুযায়ী, ওই এলাকায় ক্রাশার বসানোর জন্য বন দফতরের অনুমতি সবচেয়ে আগে প্রয়োজন। কারণ, নদীর এক পাশে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল। অন্য দিকে মহানন্দা অভয়ারণ্য। জ্যোতিপ্রিয় আরও বলেছেন, ‘‘ওই এলাকায় ক্রাশার তৈরির জন্য শুধু বন দফতর নয়, আরও উপর মহলের অনুমতির দরকার হয়। আমি তো কোনও ফাইলে সই করিনি! দেখছি বিষয়টা।’’ বনমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অবশ্য ‘ইরকন’ কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, যে সংস্থার ক্রাশার বসেছে নদীতে, তার মালিক রতন ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার প্রধান অনীত থাপার ‘ঘনিষ্ঠ’। সেই সূত্রে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে অনীত-গোষ্ঠীর লোকেদের যোগ থাকতে পারে বলেও অভিযোগ। তিস্তাবাজারের এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘এই এলাকা এবং আশপাশের যাবতীয় ক্রাশার সবই অনীতের লোকেরাই চালান।’’ এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন সাংসদ বিস্তাও। তিনি বলেন, ‘‘এটাই পাহাড়ের প্রথা। জিটিএ-তে যারা ক্ষমতায় থাকবে, তারাই নদীতে মাইনিং করবে। ইরকন হোক বা অনীত গোষ্ঠীর লোক, এই অবৈধ কাজের সঙ্গে যারা জড়়িত, তাদের সকলকে জেলে থাকতে হবে।’’

যদিও অনীতের দাবি, তিনি এ সবের সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ক্রাশার নির্মাণে জিটিএ-র কোনও ভূমিকা থাকে না। জিটিএ-র চিফ এগজ়িকিউটিভ অনীতের কথায়, ‘‘কে কী বলল, তা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। ক্রাশারের ব্যাপারে আমি জেলাশাসককে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বলেছেন, সবটাই বৈধ। এখানে জিটিএ-র কোনও ভূমিকা নেই। জিটিএ এ সবের অনুমতি দেয় না। পুরোটাই বন দফতর এবং রেল মন্ত্রকের ব্যাপার।’’

অনীতের কথায় সায় দিয়ে জেলাশাসক এস পুনমবল্লমও বলছেন, ‘‘সব অনুমতি রয়েছে।’’ পাশাপাশিই তাঁর সাফাই, ‘‘ক্রাশার নদীগর্ভে তো বসানো হয়নি। রয়েছে নদীর পারে।’’

নদীর উপর সেতু ও ক্রাশার নির্মাণের বিরুদ্ধে গ্রিন ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘মহানন্দা বাঁচাও কমিটি’। এটি ‘সম্পূর্ণ অনৈতিক’ বলে দাবি করে ওই কমিটির সদস্য জ্যোৎস্না আগরওয়াল বলেন, ‘‘আমরা ইতিমধ্যেই সব দফতরে অভিযোগ জানিয়েছি। শুধু তা-ই নয়, গ্রিন ট্রাইব্যুনালেও যাওয়ার কথা ভেবেছি।’’

পরিবেশবিদেরা বলছেন, নদীকে ‘সুবিধেমতো’ চালানোর ইচ্ছের পরিণাম কী হতে পারে, তার টাটকা উদাহরণ বিজয়া দশমীর রাতে মালবাজারের ঘটনা। প্রকৃতির শৃঙ্খলাকে বোঝার চেষ্টা না করলে বিপদ অনিবার্য বলেই জানাচ্ছেন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ওয়াইল্ডলাইফ বোর্ড’-এর সদস্য অনিমেষ বসু। তাঁর কথায়, ‘‘ক্রাশার এবং সেতু দুটোই অবৈধ। এ ভাবে নদীর গতিপথ আটকে কাজ করার কোনও নিয়ম নেই। এটা চলতে পারে না। তদন্ত হওয়া হওয়া উচিত। সামনেই করোনেশন সেতু এবং রেল সেতু। যে কোনও মুহূর্তে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।’’ শিলিগুড়ি কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম রায় বলেন, ‘‘উন্নয়ন তো হবেই। সেতু, রেলপথ, সড়কপথ— এ সবই তো উন্নয়নের মানদণ্ড। তা অবশ্যই দরকার। কিন্তু নদীর কথাও বুঝতে হবে। যত দ্রুত কাজ মিটিয়ে ক্রাশার সরিয়ে নেওয়া যায়, ততই মঙ্গল।’’

একই কথা বলছেন নদী বিশেষজ্ঞ তথা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র। তাঁর কথায়, ‘‘তিস্তার গতিপথ রুদ্ধ করে যদি এমনটা করা হয়, তা হলে তা নীচের অংশের বাস্তুতন্ত্র এবং নদীর স্বাভাবিক ভারসাম্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।’’

প্রকৃতিপ্রেমীদের একাংশের মতে, সাধারণ ভাবে ধরা হয়, তিস্তা সো লামো জোড়া হ্রদ থেকেই বেরিয়েছে। এটি ১৭,২১০ ফুট উঁচুতে। এর চেয়ে উঁচুতে ভারতে কোনও হ্রদ নেই। জোড়া হ্রদ তো নেই-ই। হিমালয়ের প্রথম বেস ক্যাম্প বসানো হয় ১৬,০০০ ফুটের একটু উপরে। সো লামো তার চেয়েও উঁচুতে। ওই পর্বতবাস ছেড়ে তিস্তা অরণ্যবাসিনী হয়েছে। সমতলে নেমে এসেছে। যুগ যুগ ধরে তিস্তার সঙ্গে নিজেদের জীবন মিশিয়ে দিয়েছেন কত জনজাতি। নদী তাঁদের নতুন নতুন জীবিকা দিয়েছে। নিজের ভিতর থেকে তৈরি করে দিয়েছে বড় বড় চর। তিস্তা মাঝেমাঝেই বন্যায় ভাসায়। চরুয়ারাও ভেসে গিয়ে আর এক চরে জীবন শুরু করে। এ নতুন কিছু নয়, আজীবন ধরে চলে আসছে। কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে তিস্তার চর থেকে যে ভাবে বালি তোলা শুরু হয়েছে, যে ভাবে সড়ক, নগরায়ণের নামে নদীগর্ভ থেকে পাথর তুলে আনা হচ্ছে, তাতে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

গজলডোবা থেকে সেবক— এই প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকায় তিস্তার পাশে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় বহু জনপদ। আর সেই মানুষগুলির রুটিরুজির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে তিস্তার স্রোত। ২০১৫ সালে সিকিম পাহাড়ে একটানা বৃষ্টির জেরে তিস্তার ফুঁসে ওঠার স্মৃতি আজও তাঁদের মনে দগদগে। তাঁদেরই এক জন নীরজ দুবে। তাঁর কথায়, ‘‘উন্নয়নের নামে নদীটাকে হত্যা করা হচ্ছে প্রত্যেক দিন। নদীকে বিপর্যস্ত করলে নদীও কিন্তু বিপর্যয় ফিরিয়ে দেবে।’’

তিস্তায় একের পর বাঁধ দেওয়ায় জলের গতি কমেছে। সেবক-লালটং ছাড়িয়ে সমতলে নামার আগেই অনেক জায়গায় নদী ঘন ঘন গতিপথে বদল আনছে। তিস্তাপারের বাসিন্দা ফণীর জীবনের ষাট বছর কেটেছে নদীর সঙ্গে সংসার করে। নদীয়ালি মাছ বেচেই এত কাল তাঁর সংসার চলেছে। হাঁটু মুড়ে জাল গুছোতে গুছোতে ফণী বলেন, ‘‘আর আগের মতো দরাজ নেই গো তিস্তা।’’ এখন নদীতে মাছ কমেছে। বাপ-দাদার জীবিকা ছেড়ে ঘরের ছেলেরা পেটের টানে দক্ষিণের রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। ফণীর মতো অনেকেরই আক্ষেপ, ‘‘রোজগার তো হচ্ছে। কিন্তু ওরা যে নদীর গায়ের গন্ধই চেনে না!’’

তিস্তার চরে সব্জির চাষ করে সংসার টেনেছেন ভানু থাপার বাবা। সেই নদী এখন অনেকটাই সরে গিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে চাষেও। এখন কচু, পটল বিক্রি করে যা রোজগার হয়, তাতে আর খিদে মেটে না। বাধ্য হয়েই বিকল্প পেশায় নামতে হয়েছে ভানুকে। তাঁর কথায়, ‘‘এখন আর আগের মতো নেই। তিস্তার উজানে সেই ছবি বদলে গিয়েছে। এখন এখানে রোজগারের ভরসাই বালি-পাথরই হয়ে উঠেছে।’’

সেবকের একটু আগে তিস্তা থেকে বালি-পাথর ওঠানোর কারবার চলে। সেখানে কাজ করেই তাঁদের পেট চলে বলে জানাচ্ছেন এলাকার শ্রমিকদের একাংশের। তিস্তাবাজারের বাসিন্দা অনীত প্রধান বলছেন, ‘‘ক্রাশার বৈধ না অবৈধ, আমি এত সব জানি না। তবে ছেলেরা তো কাজ পাচ্ছে। আমিও বালি-পাথরের কাজ করি। এই ভাবেই সংসার চলে।’’

খিদে মিটলেও এঁদের সকলের মনের কোণে চাপা ভয় বাসা বেঁধেছে। সাত বছর আগে ক্রুদ্ধ তিস্তা দেখেছিলেন এলাকার বাসিন্দা সুনীতা রাই। তিনি বলেন, ‘‘নদীর পাশেই আমাদের গ্রাম। মালবাজারের মতো কিছু ঘটলে তো আমাদেরই ক্ষতি। ছোট থেকে এই নদীকে দেখছি আমরা। প্রবাদে আছে— সোঁত মরলেও রেখ মরে না। নদী সরে গেলেও যে কোনও সময় তা আবার পুরনো খাতে ফিরে আসতে পারে। এটাই নদীধারার নিয়ম। নদীর পথ আটকে দেওয়া মানে সেই নিয়মকে অগ্রাহ্য করা।’’ প্রশাসনের কাছে সুনীতাদের আর্জি, ‘‘শুনেছি, রেলের কাজের জন্য ক্রাশার বসেছে। আমাদের আবেদন, কাজ মিটে গেলে ওটা সরিয়ে নেওয়া হোক।’’

এ ব্যাপারে অবশ্য কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেছেন রেলের আলিপুরদুয়ার শাখার ডিআরএম দিলীপকুমার সিংহ। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এ রকম কিছু হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমি অবশ্যই ওখানকার অফিসারদের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE