আমার বাড়ি থেকে দুর্ঘটনাস্থল প্রায় ১৩ কিলোমিটার। রুদ্ধশ্বাসে ময়নাগুড়ি রোড দিয়ে যাচ্ছি, দূরে দেখলাম, প্রায় আকাশে উঠে আছে ট্রেনের একটা বগি। তখন পরের অবস্থা ভাবার মত সময়, সুযোগ কিছুই নেই। ওই একটা ছবিই মনে গেঁথে যায়। ঘটনাস্থলে পৌঁছে যা দেখলাম, তা জীবনে দেখতে হবে ভাবিনি। ট্রেনের ইঞ্জিনের পরের কামরাগুলো দুমড়েমুচড়ে গিয়েছে। ভিতরে যে মানুষগুলো ছিল, তাঁদের কী অবস্থা? গাড়ি থেকে নেমেই দৌড় লাগাই ও দিকে। পিছন পিছন আমার নিরাপত্তারক্ষীরা। তখন স্থানীয়েরাও হাজির। কেউ চিৎকার করছে, কেউ লোহার দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে, কেউ আবার হাউহাউ করে কাঁদছে। আমাকে দেখতে পেয়ে ওঁরা এগিয়ে আসে। সবার মুখেই একটাই কথা, ‘‘দাদা, এটা কী হয়ে গেল!’’
আমি কী উত্তর দেব, ভেবে পাই না! তার পর হেলে পড়া একটা কামরার দরজা ভাঙতে কী চেষ্টাই না করলাম, কিন্তু লোহার দরজা ভাঙব সাধ্য কী।
পালে পালে লোক ছুটে আসছে। গুটিকয় রেলের লোক আর পুলিশ তাদের সামলাবে কী করে। সবাই তো চায় লোকগুলোকে বাঁচাতে। কিন্তু পারবে কী? এ ভাবেই একটা জানালা খুলে ফেলল কয়েক জন। এরই মধ্যে অবশ্য ওখানে চলে এসেছেন আরও অনেকে। প্রশাসনের লোকেরাও আসছেন এক এক করে। সে এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা।
আমার চোখের সামনেই দুটো ডেডবডি উদ্ধার হল। ভিতরে অনেকের চিৎকারও শুনতে পাচ্ছিলাম মনে হল। মৃতদেহের ব্যবস্থা করুক প্রশাসন। আমি আহতদের দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোয় হাত লাগাই। ভেবেই রেখেছিলাম, যদি গাড়ির সমস্যা হয়, আমার গাড়ি দিয়ে লোকগুলোকে পাঠাব হাসপাতাল।
বিকেল থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যে দৃশ্য দেখলাম, ভুলতে পারব না কোনও দিন। মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছি, বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু এই লোকগুলোকে ঠিক না করে তো কিছুই করতে পারব না। একটা সময়ের পর থেকে বগির ভিতর থেকে একের পর এক আহতদের বের করা হচ্ছিল। আমার নিরাপত্তার লোকেরাও কয়েকজনকে বের করল। তাকানো যায় না। শারীরিক ক্ষতের চেয়েও বেশি মানসিক উদ্বেগ। রক্তপাতের চেয়েও বেশি ভয় আর মৃত্যুকে খুব সামনে থেকে দেখার অনুভূতি।
বছরের এই সময় উত্তরবঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধে নামে। ঠান্ডাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। লোকগুলোর খাওয়ার ব্যবস্থা করছি সাধ্যমত। রাতটা অন্তত থাকার জন্যও কিছু ব্যবস্থা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত পাঁচটি মৃতদেহ বের করা হয়েছে। জানি না, এটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে। আরও কত কোল খালি হবে। প্রার্থনা করছি, এমন দৃশ্য যেন আর কখনও দেখতে না হয়।
লেখক ময়নাগুড়ির বিধায়ক