Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

রাত হলেই বোমা গুলি, ঘুম নেই মোজমপুরের

ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে সবে ঘুমিয়েছিলেন আমিনা বিবি (নাম পরিবর্তিত)। হঠাৎ কানফাটানো গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সকলের। দুই শিশুও ভয়ে কাঁদতে শুরু করে। তারপর স্বামী-সহ তিনি দুই শিশুকে আগলেই রাত কেটেছে তাঁদের। দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি। প্রায় এক মাস ধরে রাতের ঘুম কার্যত উড়ে গিয়েছে মোজমপুরের আমজনতার।

আহত হাকিম শেখ। নিজস্ব চিত্র।

আহত হাকিম শেখ। নিজস্ব চিত্র।

পীযূষ সাহা
কালিয়াচক শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৪০
Share: Save:

ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে সবে ঘুমিয়েছিলেন আমিনা বিবি (নাম পরিবর্তিত)। হঠাৎ কানফাটানো গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সকলের। দুই শিশুও ভয়ে কাঁদতে শুরু করে। তারপর স্বামী-সহ তিনি দুই শিশুকে আগলেই রাত কেটেছে তাঁদের। দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি। প্রায় এক মাস ধরে রাতের ঘুম কার্যত উড়ে গিয়েছে মোজমপুরের আমজনতার। সন্ধে নামতে না নামতেই হঠাৎ বোমা-গুলির শব্দে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে এলাকা। মাঝে মধ্যে দিনেও বেধে যায় সংঘর্ষ। অসহায় বাসিন্দাদের প্রশ্ন, আর ক’দিন এভাবে ভয়ার্ত হয়ে বেঁচে থাকতে হবে?

দুই গোষ্ঠীর এলাকা দখলের লড়াইয়ে প্রায় এক মাস ধরে অগ্নিগর্ভ মালদহের কালিয়াচক থানার মোজমপুর। মঙ্গলবার গভীর রাতে গুলির লড়াইয়ে একজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশ জানিয়েছে, নিহতের নাম সেলিম শেখ (৩০)। গুলি ও বোমার আঘাতে জখম হয়েছেন দু’পক্ষের তিন জন। গুলিবিদ্ধ কিসমত আলি ও ওয়াহেদ শেখকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। হাকিম শেখ নামে এক ব্যক্তিকে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। দু’টি গোষ্ঠীই জেলার তৃণমূলের নেতাদের একাংশের মদতে চলছে বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, তৃণমূলের জেলা স্তরের দুই শীর্ষ নেতা দু’টি গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, মোজমপুরে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য আসাদুল্লা বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁরই এক সময়ের ঘনিষ্ঠ রিন্টু শেখের সংঘর্ষ হচ্ছে। রিন্টুকেও আড়াল থেকে তৃণমূলের আরেক নেতা মদত দিচ্ছেন তাঁদের দাবি।

সংঘর্ষের জের এতটাই, যে মোজমপুরে যেতে চেয়েও পুলিশি নিষেধে যেতে পারেননি জেলার মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র। পুলিশের যুক্তি, মন্ত্রী এলাকায় গেলে হামলার মুখে পড়তে পারেন। সে জন্য ওই এলাকায় দলের অনুগামীরা আক্রান্ত শোনার পরেও যেতে পারছেন না বলে দাবি করেছেন সাবিত্রীদেবী। তিনি বলেন, “পুলিশ আমাকে যেতে দিচ্ছে না। আমাকে জানানো হয়েছে, এলাকায় গেলে বিপদের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে জন্য যাইনি।”

বুধবার সাবিত্রীদেবী বলেন, “রিন্টুরা নিজেদের মধ্যে গোলমাল করছে। ওই লড়াইয়ে সেলিম শেখ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে। আসাদুল্লা বিশ্বাসের সঙ্গে কোনও গোলমাল হয়নি।” পক্ষান্তরে, তৃণমূলের মালদহ জেলা সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেনের দাবি, রিন্টু এখনও কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত। যদিও এলাকারই বাসিন্দাদের একাংশের প্রশ্ন, রিন্টু যদি কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হতেন তা হলে পুলিশ কী হাত গুটিয়ে বসে থাকত? বরং বাসিন্দাদের কয়েকজন সন্দেহ প্রকাশ করে জানান, রিন্টুকে আড়াল থেকে তৃণমূলের এক তাবড় নেতা মদত দিচ্ছেন বলেই পুলিশ হাত গুটিয়ে রয়েছে। তৃণমূলের জেলার আরেক নেতা তথা মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর বক্তব্য, “মোজমপুর আগের সরকারের আমল থেকে সংঘর্ষ চলছে। গোলমালের পিছনে রাজনীতি নেই।”

পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে কংগ্রেস সাংসদ মৌসম বেনজির নূর ওই এলাকায় আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েনের দাবি তুলেছেন। মালদহ রেঞ্জের ডিআইজি সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি মনে করি মোজমপুরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশই যথেষ্ট। আধা সামরিক বাহিনী নামানোর মতো পরিস্থিতি ওখানে নেই।” মালদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক মোদী বলেন, “পুলিশ গ্রামে তল্লাশি চালাচ্ছে। গত ২১ দিনে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে পুলিশ চার জনকে গ্রেফতার করেছে। ৫৬ টি তাজা বোমা উদ্ধার করেছে।”

তবে পুলিশ-নেতাদের এই চাপানউতোরের নিয়ে ভাবতে চান না এলাকার সাধারণ মানুষ। তাঁরা চান শান্তি। এলাকার স্কুল অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। তৃণমূলের গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান ও সদস্যারা অভিযোগ করেছেন, তাঁরা গোলমালের জেরে অফিসে যেতে পারছেন না। এলাকার পঞ্চায়েত প্রধান তথা তৃণমূল নেত্রী আফরোজা বিবি বলেন, “আমার পঞ্চায়েত অফিসের সামনে যেভাবে গত ২০-১২ দিন ধরে বোমা, গুলির লড়াই হচ্ছে। তাতে আমি পঞ্চায়েত অফিসে যেতে পারছি না। বিডিও ও পুলিশকে সব জানিয়েছি। পুলিশ বলেছে, আপনি যখন পঞ্চায়েতে যাবেন তখন আমাদের বলবেন। পুলিশ নিয়ে কি অফিস করা যায়? ভয়ে পঞ্চায়েতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।” তাঁদের প্রশ্ন, “পুলিশ যেখানে মন্ত্রীকেই নিরাপত্তা দিতে পারছে না সেখানে আমাদের অবস্থাটা কী বলাই বাহুল্য।” তাঁদের অনুরোধ, “অনেক হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন অন্তত এটুকু করুক যাতে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

piyush saha kaliachak mozampur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE