Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Jagaddal Murder

খুনের সাক্ষ্য দেওয়ার মুখেই উধাও তদন্তকারী অফিসার, উন্মাদ অবস্থায় উদ্ধার ১০ দিন পর

তদন্তে পাওয়া যায়, ওই দিন তিনি থানা থেকে বেরিয়ে একটি অ্যাপ ক্যাব ধরে ধর্মতলা গিয়েছিলেন। সেখান থেকে একটি ঝাড়খণ্ডগামী একটি বাসে ওঠেন তিনি। বাসে ওঠার পর থেকেই তাঁর মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আর কোনও টাওয়ার লোকেশন পাওয়া যায়নি।

অভিষেক চৌবে। নিজস্ব চিত্র।

অভিষেক চৌবে। নিজস্ব চিত্র।

সিজার মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২১:১৪
Share: Save:

সাক্ষ্য দেওয়ার ঠিক আগের দিন রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন জগদ্দলে কিশোর অপহরণ এবং খুনের মামলার তদন্তকারী অফিসার। প্রায় ১০ দিন পর সেই অফিসারকে পাওয়া গিয়েছে সল্টলেকে। এবং কার্যত মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায়!

বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন তদন্তকারী আধিকারিকের সাক্ষ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সেই সময়ে তাঁর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা গোটা মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা আইনজীবীদের। আর পুলিশের সন্দেহ, এর পিছনে রয়েছে বড়সড় ষড়যন্ত্র!

২০১৮-র ২০ জানুয়ারি টিউশন নিতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায় উত্তর ২৪ পরগনার জগদ্দল থানা এলাকার সুন্দিয়াপাড়ার বাসিন্দা দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র অভিষেক চৌবে ওরফে প্রিন্স। নিখোঁজ হওয়ার পরেই প্রিন্সের মোবাইল থেকে মুক্তিপণ চেয়ে ফোন যায় দিল্লিতে তার জামাইবাবু উমেশ সাউয়ের কাছে। প্রথমে ১৫ লাখ টাকা এবং পরে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায় অপহরণকারীরা।

অপহরণকারীরা প্রিন্স জীবিত আছে বলে দাবি করলেও ২৪ জানুয়ারি পানিহাটির সুখচর এলাকায় গঙ্গায় ভেসে ওঠে প্রিন্সের দেহ। অপহরণ এবং খুনের মামলা শুরু করে জগদ্দল থানা। তদন্তের দায়িত্ব পান ওই থানার সাব-ইন্সপেক্টর কমল চক্রবর্তী। তদন্তে নেমে পুলিশ জগদ্দল এলাকারই তিন যুবক— মহম্মদ সাফরোজ, মহম্মদ জাহিদ এবং মহম্মদ উকিলকে গ্রেফতার করে। জানা যায় মুক্তিপণ চেয়ে ২০ জানুয়ারি তারা ওই কিশোরকে ব্যান্ডেলের জুবিলি ব্রিজের কাছে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তদন্তে জানা যায়, সেখানে তাকে জোর করে আকণ্ঠ মদ খাইয়ে বেঁহুশ করা হয়। তার পর শ্বাসরোধ করে খুন। এর পর দেহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেয় অপহরণকারীরা।

আরও পড়ুন: শিশু বিক্রি নিয়ে ফের চার্জশিটের তোড়জোড়

ধৃতদের কাছ থেকেই উদ্ধার হয় প্রিন্সের মোবাইল। সেই মোবাইল থেকেই ফোন করে মুক্তিপণের টাকা চেয়েছিল তারা। শুধু তাই নয়,ওই মোবাইল থেকে প্রিন্সের ফেসবুকে ঢুকে তার জামাইবাবুকে মেসেজও করে অপহরণকারীরা। যাতে প্রমাণ করা যায়, প্রিন্স জীবিত রয়েছে। সে কারণেই ওই মামলায় অপহরণ এবং খুনের পাশাপাশি জুড়ে দেওয়া হয় তথ্য প্রযুক্তি আইনের ধারাও।

ব্যারাকপুর আদালতে পাঁচ মাস আগে চার্জ গঠন করে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শী থেকে শুরু করে ১৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয় চার মাসের মধ্যেই। এর পর গত ৪ জানুয়ারি আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল তদন্তকারী অফিসার কমল চক্রবর্তীর।

পুলিশ সূত্রে খবর, ৩ জানুয়ারি বিকেলে ডিউটি সেরে থানা থেকে বেরোন কমলবাবু। যাওয়ার কথা ছিল চন্দননগরে নিজের বাড়িতে। কিন্তু, তিনি বাড়ি ফেরেননি। পরিবারের কাছ থেকে খবর পেয়ে কমলবাবুর খোঁজ শুরু করে পুলিশ। তাঁর মোবাইলের দু’টি নম্বরের কল ডিটেলস এবং মোবাইল টাওয়ার লোকেশন বিশ্লেষণ করে দেখা হয়।

তদন্তে পাওয়া যায়, ওই দিন তিনি থানা থেকে বেরিয়ে একটি অ্যাপ ক্যাব ধরে ধর্মতলা গিয়েছিলেন। সেখান থেকে একটি ঝাড়খণ্ডগামী একটি বাসে ওঠেন তিনি। বাসে ওঠার পর থেকেই তাঁর মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আর কোনও টাওয়ার লোকেশন পাওয়া যায়নি। কিন্তু, তাঁর ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড ব্যবহার করে রাঁচী থেকে টাকা তোলার প্রমাণ পান তদন্তকারীরা।

আরও পড়ুন: না ফিরলেই মরতে হত না, আক্ষেপ

এর প্রায় ১০ দিন পর কমলবাবুকে হঠাৎই বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের সামনের ফুটপাথে দেখতে পান তাঁরই এক পরিচিত ব্যক্তি। একটু অসংলগ্ন অবস্থায় থাকাকমলবাবুকে দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। এর পরই তিনি কমলবাবুর পরিবারের লোকজনকে ফোন করে বিষয়টি জানান। পরিবারের লোকজন আসেন। তাঁরাও দেখেন, কমলবাবুর আচরণ অত্যন্ত অসংলগ্ন। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে যেন রয়েছেন তিনি। এর পর তাঁকে অস্বাভাবিক অবস্থায় সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। সেখানে কয়েক দিন ভর্তিও ছিলেন কমলবাবু। চিকিৎসকরা জানান, মানসিক ট্রমার কারণে কোনও কিছু মনে করতে পারছেন না কমলবাবু। মানসিক স্থিতি নষ্য় হওয়ার কারণে তিনি স্পষ্ট ভাবে কথাও বলতে পারছেন না।

কয়েক দিন চিকিৎসার পরেও সুস্থ না হওয়ায় তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর স্ত্রী ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারের কাছে কমলবাবুর শারীরিক পরিস্থিতির কথা জানিয়ে ছুটির আবেদনও করেন।

আরও পড়ুন: মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, তার পর ভয়ে ছাত্রকে গঙ্গায় ছুড়ে ফেলে দিল ‘বন্ধু’রা

ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের এক শীর্ষ কর্তা গোটা বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন,“আমাদের সন্দেহ, ওই আধিকারিকের নিঁখোজ হওয়া এবং তাঁর শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে জগদ্দল মামলার যোগ রয়েছে।” বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল করতে এবং অভিযুক্তদের সুবিধা করে দিতেই এটা একটা ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন পুলিশ কর্তারা। কমিশনারেটের এক কর্তা বলেন, ‘‘এই মামলাতে এর আগেও ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য দিতে এলে তাঁকে মারধর করা হয়। অন্য এক সাক্ষীকেও ভয় দেখানোর অভিযোগও রয়েছে অভিযুক্ত এবং তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে।’’

ব্যারাকপুর আদালত সূত্রে খবর, তদন্তকারী আধিকারিকের অনুপস্থিতিতে যাতে মামলা দুর্বল না হয়ে পড়ে সে কারণে সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায়কে বিশেষ সরকারি আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। ৫ ফেব্রুয়ারি ওই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শেষ হওয়ার কথা। তদন্তকারী অফিসারের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কথা ওই দিনই আদালতে বিচারককে জানানো হবে বলে পুলিশ সূত্রে খবর।

(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া -পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Murder Kidnap Jagaddal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE