সাম্প্রতিক ভোট-অঙ্কের নিরিখে এক দল ইতিমধ্যে অনেকটাই এগিয়ে। অন্য দল হাতিয়ার করছে রাজ্যে জুড়ে পরপর ঘটে চলা ধর্ষণ, সারদা কেলেঙ্কারি, প্রাথমিকে নিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে জনমানসে তৈরি হওয়া অসন্তোষকেই। সিপিএমের দখলে থাকা বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রকে ঘিরে জেলার রাজনৈতিক মহলের পর্যবেক্ষণ, এক দিকে এই ভোট তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের কাছে রাজনীতিতে সম্পূর্ণ আনকোরা এক মুখকে জিতিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ। অন্য দিকে, জেলা বাম নেতৃত্বের কাছে আসন ধরে রেখে সম্মানরক্ষার লড়াই।
২০০৪ সালেও প্রায় ৩ লক্ষেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে তৃণমূলের নির্মল মাজিকে হারিয়ে ছিলেন ওই কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। যদিও পরের ২০০৯ সালে রাজ্যের দুই বিরোধী শক্তি তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট হওয়ায় সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোমের জয়ের ব্যবধান কমে দাঁড়ায় প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার ভোটে। ৪ লক্ষের উপরে ভোট পান জোটপ্রার্থী, হাঁসন বিধানসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মাল। আশঙ্কা তখনই তৈরি হয়েছিল। তা প্রমাণ করেই গত বিধানসভা ভোটে মমতা-ঝড়ের মুখে পড়ে ওই লোকসভা কেন্দ্রের ৭টির মধ্যে চারটিই ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল-কংগ্রেস জোট। সিপিএম মঙ্গলকোট বিধানসভা কেন্দ্রটি দখলে রাখে মাত্র ১২৬ ভোটের ব্যবধানে।
গত বিধানসভা ভোটের নিরিখে বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের ভোটের সঙ্গে বামেদের ভোটের ব্যবধান দাঁড়িয়েছে মাত্র ২,৬৪৭টি ভোটে। অবশ্য এরই মধ্যে তৃণমূল ও কংগ্রেসের যৌথ সংসারে ফাটল ধরে জোট ভেঙেছে। কিন্তু জোট ভেঙে যাওয়ার পরেও গত পঞ্চায়েত ভোটের ফলে তৃণমূলের কোনও ক্ষতি হতে দেখা যায়নি। বরং এই প্রথম লালপার্টির হাত থেকে জেলা পরিষদ ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। দখলে এসেছে জেলার সব ক’টি পুরসভাও। অবশ্য বাম ও কংগ্রেস নেতাদের যুক্তি, “বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত একাধিক বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে থাকা পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেই তৃণমূল সন্ত্রাস করে বিরোধীদের কাউকে দাঁড়াতেই দেয়নি। ফলে পঞ্চায়েতে ওখানে কোথাও ভোটই হয়নি। কিন্তু ভোট না হওয়া মানেই যে ওই সব এলাকার ভোট তৃণমূলের পকেটেই যাবে, তার কোনও মানে নেই।”
এই পরিস্থিতিতে ঘরে ঘরে গিয়ে কর্মী-সমর্থকদের তৃণমূল সরকারের ‘নীতিহীনতা’র কথা তুলে ধরার বার্তা দিয়েছেন সিপিএম প্রার্থী। সারদা-কাণ্ড, নারী নির্যাতন, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ, সিভিক পুলিশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বেশি করে দেখা যাচ্ছে সিপিএমের প্রচারেও। সিপিএম নেতাদের বিশ্লেষণ, পঞ্চায়েতে চতুর্মুখী লড়াই আর লোকসভা-বিধানসভা ভোটের চতুর্মুখী লড়াই এক নয়। আগামী লোকসভা ভোটে জোট ভাঙার খেসারত তৃণমূল পাবে বলেই তাঁরা মনে করেন। এ দিকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া পালে লাগাতে বাম নেতৃত্ব উঠে পড়ে লাগলেও তা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। পরপর ভোটে দলকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখে নীচুতলার বহু কর্মীই যে হতাশায় ভুগছেন, তা মানছেন সিপিএম নেতৃত্বও। ওই কর্মীদের প্রশ্ন, “দলের ভোট মেশিনারি বলে যারা পরিচিত, তাদের অনেকেই হয় শাসক দলে নাম লিখিয়েছেন, নয়তো বসে গিয়েছেন। এই অবস্থায় বহু বুথে দল তো এজেন্ট দেওয়ার অবস্থাতেই নেই।”
দলীয় কর্মীদের একাংশের ওই পর্যবেক্ষণের নিরিখে সিপিএমের জেলা স্তরের নেতাদের কেউ কেউ আবার পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, “পঞ্চায়েতে ওই এলাকার অনেকে তো নিজের ভোটাধিকারই প্রয়োগ করতে পারেননি। অনুব্রত যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন, সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের মধ্যে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি হচ্ছে।” তআর এক নেতার ব্যাখ্যা, “ভোট মেশিনারি বা এজেন্ট দিতে না পারা একটা ফ্যাক্টর ঠিকই, কিন্তু পুরোটা না। গত বিধানসভা ভোটেই ওই একই এলাকা থেকে তৃণমূল বহু বুথেই এজেন্ট দিতে পারেনি। তা বলে কি তারা জেতেনি? অনেকেই তো সিপিএমের এজেন্টের হাত থেকে স্লিপ নিয়েই ভোটটা তৃণমূলকে দিয়ে এসেছিলেন।” মানুষ সুস্থ ভাবে ভোট দিতে পারলে ওই কেন্দ্রটি সিপিএমই দখলে রাখবে বলে তিনি মনে করেন। শাসক দলের নেতারা অবশ্য ওই যুক্তিকে বিশেষ পাত্তা দিতে নারাজ। অনুব্রত বলছেন, “৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের প্রতি মানুষের জবাব দেওয়ার ভোট ছিল ২০১১ সালের বিধানসভা ভোট। তার সঙ্গে এই লোকসভা ভোটকে কিছুতেই মেলানো যায় না। এখানকার মানুষ দিদির উন্নয়নের কাজে সন্তুষ্ট হয়েই এ বার তৃণমূল প্রার্থীকে জেতাবেন।”
এ লড়াই অবশ্য তৃণমূল জেলা সভাপতিরও লড়াই। একের পর এক পঞ্চায়েত ও পুরসভা ছিনিয়ে আনার পরে নিজের লোকসভা কেন্দ্র দলকে ‘উপহার’ দেওয়াটাই এখন অনুব্রতর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রার্থী হিসেবে বোলপুরের উপপুরপ্রধান নরেশচন্দ্র বাউড়ির নাম ‘বাদ’ পড়ার পরে বিরোধীরা ভেবেছিলেন তৃণমূলের বহু চর্চিত গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। কিন্তু তাদের সেই আশায় জল ঢেলে ভোট প্রচারে অনুব্রত ও প্রার্থী অনুমপ হাজরা দু’জনেই হাত মিলিয়েছেন। ভোটে জেতার ব্যাপারে ১০০ শতাংশ নিশ্চিন্ত অনুপম বলছেন, “আগের সাংসদ এলাকার জন্য উন্নয়নই করতে পারেননি। সমাজকর্ম নিয়ে পড়ার সুবাদে বোলপুর কেন্দ্রের বহু জায়গায় আমি কাজ করেছি। রাজ্য সরকারের এমন উন্নয়নমূলক কর্মদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে এখানকার মানুষ এ বার আমার মতো তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিকেই সংসদে পাঠাবেন।”
আর রামচন্দ্রবাবু বলছেন, “রাজ্যে নতুন সরকার আসার পরে প্রশাসনিক অসহযোগিতা সত্ত্বেও যতটুকু পেরেছি এলাকার উন্নয়নে হাত লাগিয়েছি। বিপদে আপদে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। সংসদেও একই ভূমিকা পালন করেছি।” তাঁর দাবি, তিন বছরেই মানুষ তৃণমূলের স্বরূপ বুঝতে পারছেন। তাই মানুষ এখন শাসক দলের উপরে বীতশ্রদ্ধ। তাই মানুষ ফের তাঁকেই জেতাবেন বলে সিপিএম প্রার্থীর আশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy