দিশা বাগদি।
চিকিত্সা করাতে গেলে ঢের খরচ, তাই বাড়ির কাছে রোগের কথা গোপন করে গিয়েছিল ময়ূরেশ্বরের রামনগরের নবম শ্রেণির ছাত্রী দিশা!
কিন্তু শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে রাখতে পারল না তার কোচিং সেন্টারের সহপাঠী বন্ধুদের কাছে। তারা জেনে ফেলে দিশার অসুস্থতার কথা। আর সব জানার পর নিজেরাই ঘাড়ে তুলে নিয়েছে, দিশাকে সুস্থ করে তোলার ভার। টানা দেড় বছর ধরে তারাই চাঁদা তুলে, সহপাঠীর চিকিত্সার সেই খরচ বহন করে চলেছে। কিডনি জনিত অসুখে বছর তিনেক আগে মারা যান মা সুষমা বাগদি। তার পর থেকেই দিশা রামনগরে দাদু বিশ্বনাথ বাগদীর বাড়িতে থাকে। সেখান থেকেই সে স্থানীয় রামনগর-সাহোড়া উচ্চবিদালয়ে পড়াশোনা করে। রামনগরেরই ‘দিশা’ নামের একটি কোচিং সেন্টারে টিউশনও পড়ে সে। বছর দেড়েক আগে, ওই সেন্টারেই এক অনুষ্ঠানে সে নাচতে গিয়েই, মাথা ঘুরে পড়ে যায়। দিশার রোগের কথা তখনই জানাজানি হয়।
কোচিং সেন্টার এবং স্থানীয় সূত্রে খবর, দিশার আসল বাড়ি সাঁইথিয়ার বাগডাঙায়। বাবা পাণ্ডব বাগদি পেশায় দিনমজুর। সংসারে কার্যত নুন আনতে পান্তা ফুরনোর হাল। বন্ধুদের উদ্যোগে ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে, মায়ের মতোই কিডনির অসুখ বাসা বেঁধেছে দিশার শরীরে। ডাক্তারেরা সে সময় দিশার পরিবারকে জানিয়ে দেন, দিশাকে সুস্থ করতে হলে, টানা চার বছর চিকিত্সা চালিয়ে যেতে হবে। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে খরচ প্রায় দশ হাজার টাকা।
সে খবর শোনার পরেই, কার্যত আকাশ ভেঙে পড়ে দিশার পরিবারের মাথায়। দাদু বিশ্বনাথবাবু এতদিন বেসরকারি বাসের কন্ডাক্টরির আয়ে, কোনও রকমে সংসার চালাতেন। কিন্তু বর্তমানে বয়স জনিত কারণে তিনিও অক্ষম হয়ে পড়েছেন। এখন সংসার চলে পড়শিদের অনুগ্রহে। তা হলে দিশার চিকিত্সা হবে কী করে? ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলেন না বিশ্বনাথবাবু। একই অবস্থা বাবা পাণ্ডব বাগদিরও।
সহপাঠী পরিবারের এহেন অসহায় অবস্থা দেখে, তখন এগিয়ে আসে ওই কোচিং সেন্টারের পড়ুয়া, শিক্ষক এবং কর্মীরা। তারাই নিজেরা চাঁদা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুল, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এবং সহৃদয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে, দিশার চিকিত্সা শুরু করে প্রথমে বর্ধমান, পরে কলকাতায় চিকিত্সা করান। এখন বেঙ্গালুরুতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে দেড় বছর ধরে দিশার চিকিত্সা করাছে তারা। শুধু চিকিত্সার খরচ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়াতেই থেমে নেই তাদের উদ্যোগ। দিশাকে সঙ্গে নিয়ে চিকিত্সার জন্য কোচিং সেন্টারের শিক্ষকেরা ছুটছেন বেঙ্গালুরুও।
পড়ুয়াদের এহেন আন্তরিকতায়, আবেগে আপ্লুত দিশার পরিবার। তার দাদু বিশ্বনাথবাবু এবং দিদিমা পার্বতীদেবী বলেন, “চিকিত্সার খরচ শুনে আমরা হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম! কোচিং সেন্টারের ছেলেমেয়েদের জন্যই ও বেঁচে রয়েছে।” দিশার সহপাঠীরা অবশ্য তেমন কিছু করেছে বলে মনে করে না। মুর্শিদা খাতুন, কমল মণ্ডল, ত্রিপর্ণা দত্ত, কাজল ভল্লারা বলে, “এই রকম পরিস্থিতি আমাদের হতে পারত। আমদের চোখের সামনে কেউ বিনা চিকিত্সায় মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাবে, তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তখনই কোচিং-এর স্যারদের বলি, কিছু একটা করতে হবে। আমরা খরচ বাঁচিয়ে নিয়মিত চাঁদা তুলব। চাঁদার জন্য পথেও নামব, তাতেই কাজ হয়েছে। দেড় বছর এভাবেই চলছে।”
কোচিং সেন্টারের আঁকার শিক্ষক রানা দাস, কর্মী গোপাল দাস, অজয় দাসরা বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের ওই আকুতিই আমাদের অনুপ্রাণিত করে। চোখের সামনে একটি মেয়ে বিনা চিকিত্সায় ধুঁকবে, তা আমরাও মেনে নিতে পারছিলাম না! তখনই সিদ্ধান্ত নিই, যেমন করেই হোক দিশার চিকিত্সা করাতে হবে।” সম্প্রতি, ওই স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছাত্রছাত্রীদের জন্য সরকারের নানা রকম সহযোগিতার কথা বলেন। তাতেই অনুপ্রাণিত হয়ে, দিশা কোচিং সেন্টারের শিক্ষক চিত্তরঞ্জন গড়াই রামপুরহাটে গিয়ে আশিসবাবুর সঙ্গে দেখা করেন। চিকিত্সার জন্য আশিসবাবুর মাধ্যমে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের আবেদনও জানানো হয়। চিত্তরঞ্জনবাবু বলেন, “আশিসবাবু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে বলেছেন। সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন।” মন্ত্রী বলেন, “মেয়েটির মুখে সব শুনেছি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতেও বলেছি। যাতে সরকারি সাহায্যে তাঁর চিকিত্সা হয় তা দেখব।”
দিশার কথায়, “কোচিং স্যারদের এবং সহপাঠীদের এই অবদান আমি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছোট করতে চাই না। ওঁদের দয়াতেই তো বেঁচে রয়েছি! কিন্তু ওঁদেরও তো একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জানি না, কতদিন আর ওরা এভাবে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। কোনও সরকারি সুযোগ পেলে আরও কিছু দিন বেঁচে থাকতে পারি!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy