উদ্বোধনের বছর দু’য়েক ধরে চালু ছিল লিফ্ট। তার পর থেকে পুরোপুরি বন্ধ। তার সামনেই রয়েছে চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র। ২০১৩ সালে তৈরি হওয়া ইমারজেন্সি কেয়ার ইউনিট আজও চালু হয়নি। অবহেলায় ভেঙে যাচ্ছে আসবাবপত্র।
সাঁইথিয়া হাসপাতালের স্বাস্থ্য পরিষেবা কেমন? প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই অসুস্থ ছেলের পাশ থেকে উঠে পড়লেন সাঁইথিয়ার কানাইপুরের আনারুল শেখ। প্রায় খেপে উঠে বললেন, “বেদম জ্বর, সঙ্গে পেটে ব্যাথা হওয়ায় মঙ্গলবার দুপুরে পিয়ারুলকে ভর্তি করেছিলাম। ডাক্তারবাবুর কথা মতো ওইদিনই বাইরে থেকে জন্ডিস ও ম্যালেরিয়ার রক্ত পরীক্ষাও করিয়েছি। তাতে কিছুই মেলেনি। ছেলের জ্বরও কমছে না। শুনছি সিউড়ি রেফার করে দেবে।” রেফারের অভিযোগ মিলল, সাঁইথিয়ার দেড়পুর পঞ্চায়েতের চকধরা গ্রামের বাসিন্দা গুরুপদ মুদির মুখেও। তাঁর ছেলে বিনয়ের গত তিন চারদিন ধরে জ্বর। সোমবার সাঁইথিয়া হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ, “ঠিক পরদিন রাতেই সিউড়ি রেফার করে দেয়।”
রাজ্যজুড়েই বেহাল স্বাস্থ্য-পরিষেবার এই অভিযোগ। পুর শহর সাঁইথিয়াও তার বাইরে নয়। অপরিকল্পিত ঘন বসতির এ শহরের স্বাস্থ্য-পরিষেবা নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের তেমন কোনও ভাবনা চিন্তা আছে বলেও মনে হয় না। সাঁইথিয়া হাসপাতালে রোগীদের কাছে ‘রেফার’ শব্দটাই তাই এখন দস্তুর। ঘটনা হল, যে সব রোগীদের সিউড়ি রেফার করা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তেমন কিছু হয়নি তাঁদের। সাঁইথিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলতেই ‘রেফার’ শব্দটি লিখে থাকেন, এমনটা বলছেন কেউ কেউ। রোগীদের কথায়, “এভাবে রোগী পাঠানোয় সিউড়ির ডাক্তারবাবুরাও বিরক্ত হন।”
শহরের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে সাঁইথিয়া হরপলসা গ্রামের যুবক শেখ নাসিরুদ্দিন, সাঁইথিয়া ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা প্রিয়া সিংহও নানা অভিযোগ জানালেন। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে হাসপাতালে ঢুকতেই নাকে এল দুর্গন্ধ। ভিতরে ঢোকাই দায়। দিনের পর দিন এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই থাকতে হয় রোগীদের। চারিদিকে নোংরা, আবর্জনা আর শুয়োর কুকুর বিড়ালের অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাসিন্দাদের কথায়, এ শহরে মশার উপদ্রবও চরম।
অন্যদিকে কুকুরে কামড়ানো এআরভি সিরাম সাঁইথিয়াতে মিললেও এআরএস সিরামের জন্য সিউড়ি যেতে হয় এখনও। গত মঙ্গলবারই সাঁইথিয়ার হরপলসা গ্রামের আনোয়ার হোসেনকে কুকুরে কামড়ায়। তাঁকেও এআরএস সিরামের জন্য সিউড়ি সদর হাসপাতালে যেতে বলে সাঁইথিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ দিকে জেলায় যে কটি বিপিএইচকে গ্রামীণ হাসপাতাল ঘোষনা করা হয়, তার মধ্যে সাঁইথিয়ারটি সব চেয়ে বড়। সরকারিভাবে, ১৯৫১-৫২ সালে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট সাঁইথিয়া গ্রামীণ হাসপাতালের পথচলা শুরু। ১৯৬৬ সালে পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্পের সময় ১০টি শয্যা বাড়িয়ে ৬০টি করা হয়। কিন্তু কর্মী থেকে বাকি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থায় আজও ঘাটতি রয়ে গেছে। ফলে জেলার সব থেকে বড় বিপিএইচটি নানা ভারে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে দীর্ঘ দিন থেকে ধুকছে।
হাসপাতালের পুরুষ বিভাগে ছিঁড়ে গিয়েছে শয্যা।
এই ধুকতে থাকা হাসপাতালের কোনওরকম উন্নয়ন না করেই ১৯৯১ সালের ৬ অগস্ট এইচএসডিপি ২ প্রকল্পে সাঁইথিয়া গ্রামীণ হাসপাতাল ঘোষণা করে দেওয়া হয়। সাইঁথিয়া ও সংলগ্ন ৬টি পঞ্চায়েত এলাকা, ময়ূরেশ্বর ও লাভপুরের একাংশ গ্রামীণ হাসপাতালের উপরই নির্ভর করে। এখন তার বেহাল এই চিত্র। কিন্তু শহরের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে পুরসভা কি বলছে? পুরসভার দাবি, অভিযোগ সব ঠিক নয়। শহরবাসীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে অনেক আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাঁইথিয়া গ্রামীণ হাসপাতালের পাশাপাশি কয়েকটি স্বাস্থ্য প্রকল্পের সঙ্গে পুরসভা সরাসরি যুক্ত। ওই সব প্রকল্পে বিপিএল তালিকাভুক্ত গর্ভবতী মা থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের চিকিৎসা সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে। অভিযোগ, সেই সুবিধার সব মেলে না।
গ্রামীণ হাসপাতাল ঘোষণার কয়েক বছর পর ওই একই প্রকল্পে প্রায় দু’কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৯৮ সালে নতুন অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ তৈরি হয়। ২০০২ সালে ঘটা করে গ্রামীণ হাসপাতালের উদ্বোধন করেন তৎকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি ঘোষণা করেছিলেন গ্রামীণ হাসপাতাল যে সব সুযোগ সুবিধা পাওয়ার কথা, এবার থেকে তার সবই মিলবে। রাজ্যে পালাবদলের পরও, এ স্বাস্থ্য পরিষেবার বদল হয়নি প্রায় কিছুই! মেলেনি সেই পরিষেবাও।
কি বলছেন কর্তৃপক্ষ?
বিএমওএইচ কবিতা সাসমল বলেন, “শুয়োর কুকুর নিয়ে কিছু করার নেই। কারণ কোনও প্রহরী নেই। বাউন্ডারি ওয়ালও নেই। চিকিৎসক থেকে সমস্ত স্তরের স্বাস্থ্যকর্মী কম। গ্রামীণ হাসপাতালের পরিকাঠামো এখানে নাই। এদিকে রোগীর চাপ বাড়ছে দিন দিন।”
ছবি: অনির্বাণ সেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy