Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

রান্নার সরঞ্জাম পেয়ে চোখে জল চঞ্চলাদের

দিন বদলেছে। নেই সেই বাধ্যবাধকতাও। কিন্তু, প্রাচীন ভোজন-দক্ষিণা প্রথা আজও ধরে রেখেছে কীর্ণাহারের ‘আমরা ক’জন’। একসময় ভুরিভোজের সঙ্গে ভোজন-দক্ষিণা দেওয়ার প্রথা ছিল। মূলত ব্রাহ্মণদেরই ওই দক্ষিণা দেওয়া হতো। প্রচলিত রয়েছে, ভদ্রপুরের মহারাজ নন্দকুমারও নাকি ব্রাহ্মণদের ভোজন-দক্ষিণা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই প্রথা আর নেই। বরং খাওয়ার পরে গৃহকর্তার হাতে নিমন্ত্রিতদের উপহার তুলে দেওয়াটাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমরা ক’জন আয়োজিত ভিক্ষাভোজন। বুধবার ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।

আমরা ক’জন আয়োজিত ভিক্ষাভোজন। বুধবার ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কীর্ণাহার শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৫ ০১:২৯
Share: Save:

দিন বদলেছে। নেই সেই বাধ্যবাধকতাও। কিন্তু, প্রাচীন ভোজন-দক্ষিণা প্রথা আজও ধরে রেখেছে কীর্ণাহারের ‘আমরা ক’জন’।

একসময় ভুরিভোজের সঙ্গে ভোজন-দক্ষিণা দেওয়ার প্রথা ছিল। মূলত ব্রাহ্মণদেরই ওই দক্ষিণা দেওয়া হতো। প্রচলিত রয়েছে, ভদ্রপুরের মহারাজ নন্দকুমারও নাকি ব্রাহ্মণদের ভোজন-দক্ষিণা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই প্রথা আর নেই। বরং খাওয়ার পরে গৃহকর্তার হাতে নিমন্ত্রিতদের উপহার তুলে দেওয়াটাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, আজও কীর্ণাহারে ভোজের পরে দক্ষিণা দেওয়ার প্রথা টিকে রয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল, বিগত দিনের বর্ণশ্রেষ্ঠদের নয়, বরং সমাজের উপেক্ষিতদের সমাদরে ওই দক্ষিণা দেওয়া হয়। তবে, নগদে নয়। প্রতি বছর একটি করে গৃহস্থালির সামগ্রী নিমন্ত্রিত হাতে তুলে দেন উদ্যোক্তারা।

স্থানীয় সূত্রের খবর, গত ৯ বছর ধরে ভিখারিদের নিয়ে ওই পঙ্‌ক্তি ভোজের আয়োজন করে চলেছেন স্থানীয় কিছু যুবক। এ বারও স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া মাঠে ভোজের আয়োজন হয়। বুধবার সকাল থেকে তাই সাজো সাজো রব। শুধু জেলার বিভিন্ন প্রান্তই নয়, লাগোয়া বর্ধমান এবং মুর্শিদাবাদ থেকেও শ’তিনেক ভিক্ষাজীবী নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হাজির হন। প্রথমেই তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সরবতের গ্লাস। চা-বিস্কুট, মুড়ি-ঘুগনি-বোঁদে দিয়ে টিফিনের পরে কার্যত পিকনিকের মেজাজে পৌঁছে যান ভিক্ষাজীবীরা। মাইক্রোফোন হাতে কীর্তন গেয়ে ওঠেন বোলপুরের অন্নপূর্ণা দাস, নানুবাজারের হিরু দাসেরা। বাকিরাও তাতে গলা মেলান। কাঁদরার কৃষ্ণকান্ত বৈরাগ্য, সাঁইথিয়ার চাঁদ দাসরা যখন বাউল গান ধরেন, তখন তাল দিতে দেখা যায় উদ্যোক্তাদেরও। সকলেই ভুলতে বসেন খাওয়ার কথা। ওই ভিক্ষাজীবীরা বলেন, ‘‘আমরা বিভিন্ন জায়গায় গান গেয়ে ভিক্ষা করি। কোনও দিন তো মাইক্রোফোনের সামনে গাওয়ার সুযোগ হয়নি। তাই মাইক্রোফোন ছাড়তেই মন চাইছিল না।’’

দুপুরের খাবারের মেনুতেও ছিল নানা পদ। ভাত, ডাল, পঞ্চরত্ন থেকে শুরু করে পাঁপড় পর্যন্ত। খাওয়ার পরে বাড়ি যাওয়ার আগে সবার হাতে তুলে দেওয়া হল কড়াই। একই সঙ্গে কর্মকর্তারা আগামী বছরের জন্য উপস্থিত ভিক্ষাজীবrদের নিমন্ত্রণ সেরে রাখলেন। উদ্যোক্তাদের পক্ষে চঞ্চল দাস, সুবীর মণ্ডলরা বলেন, ‘‘এটাই আমাদের রীতি। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বুধবার এই ভোজের আয়োজন করা হয়। সেই মতো প্রতিবার খাওয়ার পর পরের বছরের জন্য নিমন্ত্রণও জানিয়ে দেওয়া হয়।’’ কেন এই উদ্যোগ? জটাধারী কর্মকার, নিত্যনিরঞ্জন দত্তরা জানান, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে ওই সব ভিক্ষাজীবীদের করুণ অবস্থা তাঁরা খেয়াল করেছেন। তখনই ওঁদের জন্য বছরের একটা দিন সম্মানের সঙ্গে খাওয়ানোর কথা তাঁদের মাথায় আসে। তাঁরা বলেন, ‘‘আমরা বেশির ভাগই ছোটখাটো ব্যবসা করি। তাই খরচ তোলার জন্য সারা বছর ধরে কিছু কিছু করে জমিয়ে রাখি।’’

এ দিন কড়াই হাতে বাড়ি ফেরার মুখে কেঁদেই ফেললেন মুর্শিদাবাদের সোনারুন্দির ৬৫ বছরের স্নেহময়ী আচার্য, লাভপুরের পূর্ব কাদিপুরের ৬৬ বছরের চঞ্চলা দাসেরা। আবেগ আপ্লুত গলায় তাঁরা বলেন, ‘‘আমাদের তো কেউ নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায় না। তবু কোথাও কোথাও বিনা নিমন্ত্রণে হাজির হই। সবার শেষে শেষ পাতের খাবার জোটে। কোথাও বা খাওয়া যা জোটে তার চেয়ে তুচ্ছ তাচ্ছল্য শুনতে হয় বেশি।’’ খাবারের সঙ্গে মিশে যায় চোখের জল। তার থেকে এ দিন মুক্তি মেলে বলেই তাঁরা জানান। আমোদপুরের ৫০ বছরের পুষ্প দলুই, ভালাসের ৪৮ বছরের ক্ষুদিরাম মণ্ডলরা জানান, তাঁদের অধিকাংশেরই একবেলা গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে বাড়ি ফিরে রান্না করার পরে তবেই খাওয়া জোটে। সবার বাড়িতে রান্না করার সব সরঞ্জামও নেই। ‘‘কিন্তু, বছরের একটা দিন আমরাও বাবুদের মতো আরামে খেতে পাই। প্রতি বছর রান্নার জন্য বালতি, হাঁড়ি, কড়াইও পাই। এটাই আমাদের কাছে অনেক!’’—বলছেন পুষ্পদেবীরা।

সব শেষ হয়ে গেলে সুনীল রায়, অজয় ঘোষরা জানান, হতদরিদ্র ওই ভিক্ষাজীবীদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগবে বলেই দক্ষিণা হিসাবে নানা গৃহস্থালির সামগ্রী দেওয়া হয়। তাঁরা বলছেন, ‘‘দানের অহমিকা নয়। বরং নিমন্ত্রণ রক্ষা করে ওঁরাই আমাদের সম্মান রেখেছেন। এটা বোঝাতেই আমরা প্রতিদান হিসাবে ওই প্রথা চালু করেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE