শীর্ষা গ্রামের ছোটবাড়ির নতুন প্রতিমা। ছবি : দয়াল সেনগুপ্ত।
ঠাকুরদালান যেন মেলাতলা!
কাঠ, বাঁশ দিয়ে তৈরি পাটাতনের উপর খড়, মাটি, রঙে একটু একটু করে সেজে উঠছে দেবীর মৃণ্ময়ী রূপ। সেই দেখতে ভিড়। কাঠামোয় পালবাবু হাত দিলেন কি, শুরু হয়ে গেল উৎসব। রথের দিন থেকে শুরু। একাদশীর দুপুরে বির্সজনে শেষ।
দু’শো বছরের বেশি সময় ধরে এটাই ছিল রীতি। সেই রেওয়াজ বদলে গেল এ বার!
ইলাবাজারের শীর্ষা গ্রামে দু’টি শতাব্দী প্রাচীন দুর্গামন্দিরে এল দুর্গার শীলা মূর্তি। বাঁকুড়া শুশুনিয়া পাহাড় থেকে আনা পাথরের তৈরি দু’টি দুর্গামূর্তিকে ঘিরেই নতুন করে উৎসাহ তৈরি হয়েছে গ্রামের কর্মকার পরিবারের বড়বাড়ি ও ছোটবাড়ির মধ্যে। বড়বাড়ির মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রথের দিন। ছোটবাড়িতে শিলামূর্তি প্রতিষ্ঠা হল শনিবার।
একসময় অজয় নদের ধার ঘেঁষা ইলামবাজারের শীর্ষা গ্রামের সুখ্যাতি ছিল লোহার কোদাল তৈরির জন্য। ১৬০টি কর্মকার পরিবারের বানানো সেই কোদাল ছড়িয়ে পড়ত বর্ধমান, কলকাতা, অধুনা ঝাড়খণ্ড-সহ নানা জায়গায়। তবে পারিবারিক ইতিহাস বলছে, কোদাল নিয়ে অন্যত্র ব্যবসা করতে যাওয়ার সময় পূর্বপুরুষ দুই ভাই গুপ্তধন পাওয়ার পরেই শতাব্দী প্রাচীন দুটি দুর্গাপুজো শুরু হয়।
ছোট পরিবারের বর্ষিয়ান সদস্য মৃগাঙ্ক শেখর কর্মকার বলছেন, সনটা ১২০৬। কোদাল নিয়ে ব্যবসা করতে যাওয়ার সময়ে তাঁদের পূর্বপুরুষ গয়ারাম মণ্ডল ও তার দাদা পানাগড়ের কাছে শ্যামারূপার জঙ্গল পিতলের কলসীতে সোনার মোহর পান। তবে গয়রামের দাদার নাম কী ছিল তা জানা নেই। গুপ্তধন প্রাপ্তির পর অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। তারপরেই শুরু হয় দূর্গাপুজো। অন্যদিকে বড় বাড়ির বর্ষিয়ান সদস্য অবণীধর দাস, মূরলীধর দাসেরা বলছেন, গয়ারাম মণ্ডলের দাদার নাম রায়কিশোর মণ্ডল ছিল। গুপ্তধন পাওয়া গিয়েছিল অধুনা ঝাড়খণ্ডের কাছে কোনও এক জঙ্গলে।
কোথায় গুপ্তধন পেয়েছিলেন তাঁরা— গয়ারাম মণ্ডলের দাদার নাম রায়কিশোর ছিল কিনা, তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে দুটি পরিবারে।
তবে যা নিয়ে মত পার্থক্য নেই তা হল, গুপ্তধন পাওয়ার পরেই রাতারাতি অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে গিয়েছিল দুই ভাইয়ের। এবং দুশো বছর আগে থেকে দুই পরিবারে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। সম্পত্তি পাওয়ার নিরিখে কিছুটা এগিয়েছিল বড় পরিবার। তবে বর্তমানে যাঁদের হাতে পুজোর ভার তাঁদের সকলেই দৌহিত্র। তাই মণ্ডল পদবি বদলে গিয়েছে কর্মকার ও দাসে। ছোটবাড়ির পুজো এখন এখন মূলত দুটি পরিবারের কাঁধে। অন্যদিকে বড়বাড়ির শরিক সংখ্যা পাঁচজন। জমিদারী কবেই গিয়েছে। কী পরিমাণ বৈভব ছিল শীর্ষার ওই একদা জমিদার বাড়ির তা দুর্গা দালানের পাশে থাকা একাধিক শিব মন্দির টেরাকোটার বিষ্ণু মন্দির, ভগ্নপ্রায় হাতিশাল থেকেই একটা আঁচ পাওয়া যায়।
এমন যাঁদের ঐতিহ্য তাঁরা হঠাৎ শিলামূর্তি আনার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?
দুই পরিবারের সদস্য পার্থ কর্মকার, কুন্তল কর্মকার, সুশান্ত দাস, অবণীধর দাসেরা বলছেন, প্রতি বছর বাড়ছিল প্রতিমা তৈরির খরচ। সঙ্গে বিসর্জন-সহ নানা খরচও। নতুন প্রজন্ম ভবিষ্যতে এত ঝামেলা পোহাতে পারবে কিনা বা আদৌ খরচ চালানোর অবস্থায় থাকবে কিনা সে সব কথা চিন্তা করেই শিলামূর্তি আনার ভাবনা। তাহলে আর প্রতিমা তৈরি ও বিসর্জনের বাঁধা খরচ আর করতে হবে না। দুটি পরিবারই জানাচ্ছে, বাঁকুড়ার শুশুনিয়া গিয়ে শিল্পী শান্তিময় কর্মকারকে শিলামূর্তি বানানোর বায়না দেন কয়েক মাস আগেই। রথের আগেই একচালি পাথরের দুর্গা মূর্তি পৌঁছে গিয়েছিল বড় বাড়িতে। আর গত শনিবার দুর্গা-সহ পাঁচটি আলাদা মূর্তি এসেছে ছোট পরিবারে। খোদ শিল্পী তাঁর লোকজন এনে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছেন দুর্গা মূর্তি। পাথরের তৈরি দূর্গার উপর প্লাস্টিক রঙ করা।
এ বারই প্রথম শিলামূর্তি। বাড়তি উৎসাহ তৈরি হয়েছে, দুই বাড়ির সদস্যদের মধ্যে। ছোটবাড়ির বধূ সুমিতা সিংহ কর্মকার, সুনন্দা কর্মকার, শোভা কর্মকার এবং বড়বাড়ির নিভারানি দাস, সান্তনা দাস, তাপসী দাসেরা বলছেন, এমনিতেই পুজোর জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকতাম। কিন্তু মাত্র চারদিনই সীমিত থাকত আনন্দ। বিসর্জনের সময় মনটা খারাপ হয়ে যেত। মনমরা হয়ে যেত ছোটরাও। এ বার থেকে তো আর মা-কে বিসর্জন করতে হবে না তাই আলাদা অনুভূতি হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy