Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

তিন টাকার ভাড়া ঘরে শুরু পুরসভা

সাহেবরা পুরুলিয়া গ্রামে জেলা সদর গড়ার ৩৮ বছর পরে পুরসভা গঠন করেন। সেই পুরুলিয়া পুরসভার হাত ধরেই আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে জনজীবন। গ্রাম বদলাতে থাকে নগরে। ১৮৭৬ সালে তৈরি হয় পুরুলিয়া পুরসভা। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, গোড়ায় আমলাপাড়া, চকবাজার, মুন্সেফডাঙা, ভাটবাঁধ, নডিহা, নীলকুঠিডাঙা, নামোপাড়া বা নামো পুরুলিয়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলি ছিল পুরসভার আওতায়। আয়তন ছিল ৫ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ছিল হাজার ছয়েক। পুরসভার নিজস্ব ভবন ছিল না।

শহরের প্রাচীন ভবনগুলির অন্যতম গাঁধী হল। দীর্ঘদিন ধরে এখানেই পুরসভার বৈঠক হয়ে আসছে।

শহরের প্রাচীন ভবনগুলির অন্যতম গাঁধী হল। দীর্ঘদিন ধরে এখানেই পুরসভার বৈঠক হয়ে আসছে।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৩৮
Share: Save:

সাহেবরা পুরুলিয়া গ্রামে জেলা সদর গড়ার ৩৮ বছর পরে পুরসভা গঠন করেন। সেই পুরুলিয়া পুরসভার হাত ধরেই আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে জনজীবন। গ্রাম বদলাতে থাকে নগরে।

১৮৭৬ সালে তৈরি হয় পুরুলিয়া পুরসভা। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, গোড়ায় আমলাপাড়া, চকবাজার, মুন্সেফডাঙা, ভাটবাঁধ, নডিহা, নীলকুঠিডাঙা, নামোপাড়া বা নামো পুরুলিয়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলি ছিল পুরসভার আওতায়। আয়তন ছিল ৫ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ছিল হাজার ছয়েক। পুরসভার নিজস্ব ভবন ছিল না। গাড়িখানা এলাকার একটি বাড়িতে মাসিক তিন টাকা ভাড়ায় পুরসভার অফিস চলত। পরে ভাড়া বেড়ে হয় চার টাকা। পুরসভার মাসিক বৈঠক বসত সার্কিট হাউসে। প্রাক্তন পুরপ্রধান বিনায়ক ভট্টাচার্যের কথায়, “পুরসভার গাড়িখানা ক্যাম্পাসে ওই বাড়িটি ছিল বলে জানি। তবে আলাদা ভাবে বাড়িটি এখন চেনা যায় না।” জেলার ইতিহাস গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামীর কথায়, “১৮৮১ সালের ২৮ মার্চ পুরসভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক কেতিকা ও দুলমি এই দু’টি এলাকা পুরুলিয়া পুরসভার আওতায় আসে। মূলত কেতিকার তালুকদার কীর্তিচাঁদ চৌধুরীর উদ্যোগেই ওই দু’টি এলাকা পুরসভার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।”

পুরুলিয়া পুরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হন ডেপুটি কমিশনার আর্থার লয়েড ক্লে। এখন যেখানে চকবাজার সেখানেই শহরের প্রথম বাজার চালু হয়েছিল। ১৮৮০ সালে বাজার সরিয়ে আনা হয়। উদ্বোধন করেন লয়েড ক্লে। তাঁর নামানুসারেই বাজারের নাম হয় লয়েড মার্কেট। পরে লোকমুখে তা হয় বড়হাট। তখন চকবাজারের দোকানের ভাড়া ছিল দিন প্রতি এক আনা আর এই বাজারের দু’টি ঘর প্রতি দু আনা। আজও এই বাজারের মধ্যে জরাজীর্ণ অবস্থায় সেই নির্মাণটি রয়েছে। ১৮৬৭-১৯১৫ সাল পর্যন্ত ১৩ জন সাহেব পুরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে আসেন। উইলকক্স রোড, রেনি রোড, জে ল্যাঙ রোড, কুকস কম্পাউন্ড প্রভৃতি রাস্তার নামের সঙ্গে সেই সময়কার সাহেব প্রশাসকদের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। যেমন, জার্মান সাহেব উফমানের নামানুসারে পুরুলিয়া শহরের উপকন্ঠে রয়েছে উফমানপুর, আর্থার লয়েড ক্লের নামানুসারে ক্লে স্কোয়ার। প্রশাসনের আধিকারিকদের বাইরে প্রথম ১৯১৫ সালে পুরসভার চেয়ারম্যান হন নীলকন্ঠ চট্টোপাধ্যায়। প্রথম মহিলা পুরপ্রধান হন রেখা মল্লিক, ১৯৮১ সালে।

সেই সময়েই পুরুলিয়ার সঙ্গে আশপাশের বড় শহরের যোগাযোগ গড়তে তৈরি হয় চারটি বাড় রাস্তা: রাঁচি রোড, বরাকর রোড, চাইবাসা রোড ও পুরুলিয়া-বাঁকুড়া রাস্তা। এই চারটি রাস্তা পুরুলিয়ার পোস্ট অফিস মোড়ে যুক্ত। ওই মোড়ই এখন শহরের প্রাণকেন্দ্র। শহরের মধ্যে দিয়ে ছিল ইন্ডিগো ফ্যাক্টরি রোড। এই রাস্তাটি ছিল হাটমোড় থেকে পূর্বদিকে তেলকল পাড়া হরিমন্দির অবধি। বর্তমানে এই রাস্তাটিকে শহরবাসী শরৎচন্দ্র সেন রোড নামে চেনেন। পুরুলিয়া রেলপথে যুক্ত হল ১৮৮৯ সালে। সেই আদ্রা-সিনি রেলপথ ওই রাস্তাকে দু’ভাগ করেছিল। পরে বাস চালু হয়। এখন যেখানে ট্যাক্সস্ট্যান্ড, সেখান থেকে জেলা পুলিশ অফিস পর্যন্ত বাস দাঁড়াত। ওটাই ছিল তখনকার বাসস্ট্যান্ড।

পুরুলিয়ার বর্তমান পুরভবন। ছবি: সুজিত মাহাতো

এই শহরে উড়োজাহাজও নেমেছে। পুরুলিয়ার থানাগুলির ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এখন যেখানে জেলা পুলিশ লাইন, আগে সেই মাঠে রাজা-জমিদার-সাহেবসুবোরা পোলো খেলতেন। এই মাঠে মাঝে মধ্যে ছোট উড়োজাহাজ নামত। দু-একদিন থেকে নিজস্ব গন্তব্যে ফিরে যেত। এগুলি যাত্রীবাহী না হলেও আগ্রহী মানুষজনদের কিছু টাকার বিনিময়ে এক চক্কর শহর ঘুরিয়ে নামিয়ে দিত। পরে জেলা পুলিশ পোলো ক্লাবের এই মাঠটি কিনে নেয়।

শিক্ষা বিস্তারের জন্যও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছিল। স্বাধীনতার ঠিক পরেই ১৯৪৮ সালের ২২ জুলাই গড়ে উঠেছিল জগন্নাথ কিশোর কলেজ। পঞ্চকোট রাজবংশের সন্তান জগন্নাথ কিশোরলাল সিংহ দেওয়ের স্মৃতিতে তাঁর পত্নী গোকুল কুমারীদেবী এই কলেজ গড়তে সে সময় এক লক্ষ টাকা দান করেন। তারপরে ১৯৫৭ সালের ১৭ অগস্ট গড়ে ওঠে নিস্তারিণী মহিলা মহাবিদ্যালয়। শহরের প্রখ্যাত স্থপতি অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাঁচি রোডের স্বপনপুরী নামের বাড়িতে গোড়ায় কিছু দিন ভাড়ায় কলেজ চলে। বাবা ভুবনমোহন দাস ও মা নিস্তারিণীদেবীর বসবাসের জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস পুরুলিয়া শহরে ক্লার্কস বাংলো নামে একটি বাড়ি কিনেছিলেন। নিস্তারিণীদেবী ওই বাড়িতেই মারা যান। সেখানে তাঁর সমাধিও রয়েছে। ভূবনমোহন কলকাতায় মারা গেলে তাঁর চিতাভস্ম এনে এখানে স্ত্রীর সমাধির পাশে রাখা হয়। পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই বাড়িটি কিনে নেয় মহিলা মহাবিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য। কলেজের নামকরণ হয় নিস্তারিণী দেবীর নামে। ১৯৫৯ সালের ২০ ডিসেম্বর বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় এই কলেজের উদ্বোধন করেন। লেখিকা সাহানাদেবীর স্মৃতির খেয়া গ্রন্থে চিত্তরঞ্জন দাসের এই বাড়িটির বর্ণনা রয়েছে।

পুরুলিয়া শহরকে একে একে সাজানোর সময় ১৯২১ সালে গড়ে ওঠে মানভূম জেলার প্রাচীন গ্রন্থাগার— সাহিত্য মন্দির। হরিপদ খাঁ নামে এক সমাজসেবী গ্রন্থাগারের বাড়ি তৈরি দেন। গ্রন্থাগারের নাম হয় হরিপজযদ সাহিত্য মন্দির। ১৯৬০ সালে এই গ্রন্থাগারের একটি সংগ্রহশালা গড়ে ওঠে।

যে কথার উল্লেখ না করলে পুরুলিয়ার কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তা হল এই শহরের একদা রাজনীতির আঁতুড়ঘর শিল্পাশ্রম। ঠিকানা বদলে বদলে ইতিহাস বুকে জরাজীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় দশা নিয়ে সেই আশ্রম আজও শহরের পূর্বপ্রান্তে তেলকল পাড়ার দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখান থেকেই পরিচালিত হয়েছে জেলার ভাষা আন্দোলন। যে আন্দোলন পুরুলিয়াকে যুক্ত করেছিল পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে।

পুরুলিয়া জেলাশাসকের কার্যালয়ের ইতিহাস এখনও আবছা। চেষ্টা করা হয়েছে আলো ফেলার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE