Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বৃষ্টি নামলেই লোডশেডিং, ক্ষোভ ময়ূরেশ্বরের গ্রামে

মনিরুদ্দিন খানের বাড়ি থেকে মিঠু গড়াইয়ের বাড়ির দূরত্ব আধ কিলোমিটারেরও কম। মিঠু গড়াই ময়ূরেশ্বরের ঢেকা পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান। একই পঞ্চায়েতের একই দলের উপপ্রধান মনিরুদ্দিন খান। দু’জনের বাড়িতেই বিদ্যুতের বৈধ সংযোগ রয়েছে। নিয়মিত বিলও দেন। কিন্তু দু’জনের বাড়িতে বিদ্যুৎ পরিষেবার ফারাক বিস্তর। অভিযোগ, মাসের পনেরো দিনই বেশির ভাগ সময়ে বিদ্যুৎ থাকে না মনিরুদ্দিনের বাড়িতে। অথচ একই সময়ে মিঠুদেবীর বাড়িতে আলো জ্বলে, পাখাও চলে।

বিদ্যুৎ নেই গ্রামে। হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় এ ভাবেই চলে পড়াশোনা। —ফাইল চিত্র

বিদ্যুৎ নেই গ্রামে। হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় এ ভাবেই চলে পড়াশোনা। —ফাইল চিত্র

অর্ঘ্য ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৪ ০০:১৭
Share: Save:

মনিরুদ্দিন খানের বাড়ি থেকে মিঠু গড়াইয়ের বাড়ির দূরত্ব আধ কিলোমিটারেরও কম। মিঠু গড়াই ময়ূরেশ্বরের ঢেকা পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান। একই পঞ্চায়েতের একই দলের উপপ্রধান মনিরুদ্দিন খান। দু’জনের বাড়িতেই বিদ্যুতের বৈধ সংযোগ রয়েছে। নিয়মিত বিলও দেন। কিন্তু দু’জনের বাড়িতে বিদ্যুৎ পরিষেবার ফারাক বিস্তর। অভিযোগ, মাসের পনেরো দিনই বেশির ভাগ সময়ে বিদ্যুৎ থাকে না মনিরুদ্দিনের বাড়িতে। অথচ একই সময়ে মিঠুদেবীর বাড়িতে আলো জ্বলে, পাখাও চলে। না, এখানে পদমর্যাদার ফারাকের কোনও গল্প নেই। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানির গাফিলতির জেরেই মনিরুদ্দিনকে এমন বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ।

তবে, শুধু মনিরুদ্দিনই নন। অভিযোগ, ময়ূরেশ্বরের বিস্তীর্ণ এলাকার কয়েক হাজার গ্রাহককেই নিত্যদিন এই বৈষম্যের শিকার হতে হয়। জানা গিয়েছে, স্থানীয় কোটাসুর সাব-স্টেশন থেকে চারটি ফিডারের মাধ্যমে কয়েক হাজার গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। তার মধ্যে বাসুদেবপুর ফিডারকে দু’টি ভাগে ভাগ করে ওই সরবরাহ করা হয়। একটি শাখা কলেশ্বর, গিধিলা-সহ বিভিন্ন গ্রাম হয়ে মিঠু গড়াইয়ের কুলিয়ারা গ্রামে পৌঁছেছে। অপর শাখাটি বাসুদেবপুর, বারগ্রাম, নবগ্রাম, লোকপাড়া-সহ মনিরুদ্দিনের গ্রাম বজরহাটেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। অন্যান্য ফিডার-সহ বাসুদেবপুর ফিডারের কুলিয়ারার অংশে বিদ্যুৎ থাকলেও এক পশলা বৃষ্টিতেই মনিরুদ্দিনের গ্রাম বজরহাটে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কখনও কখনও প্রায় ১০-১২ ঘণ্টাও ওই সরবরাহ বন্ধ থাকে বলে অভিযোগ।

বণ্টন কোম্পানি সূত্রে খবর, বাসুদেবপুরের বজরহাটে অংশের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনটি দীর্ঘ দিনের পুরনো। অধিকাংশ জায়গায় ছেঁড়া, তার জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালানো হয়। সামান্য ঝড়েই সেই তার ফের ছিঁড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আবার বহু জায়গায় দীর্ঘ দিন ধরে ফাটল রয়েছে চিনেমাটির ‘কাপ ডিসে’। একটু বৃষ্টি হলেই ওই সব ভাঙা ‘কাপ ডিসে’ চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল ঢুকে শর্ট সার্কিট হয়ে যায়। তার জেরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন দফতরের কর্মীরা জোড়াতালি দিয়ে কোনও রকমের বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করলেও ফের বৃষ্টিতে একই হাল হয়। ফলে বারবার সমস্যায় পড়েন বাসিন্দাদের।

লোকপাড়া মোড় ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুভাষ ঘোষ, স্থানীয় লোহার কারবারি ফটিকচন্দ্র দে-রা বলেন, “আকাশে মেঘ দেখলেই আমরা হ্যারিকেন আর হাতপাখা জোগাড় করে রাখি। কারণ, একটু বৃষ্টি হলেই দীর্ঘ ক্ষণ বিদ্যুৎ থাকে না।” সব থেকে সমস্যায় পড়েছে পড়ুয়ারা। বেলেরা গ্রামের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী শর্মিষ্ঠা মণ্ডল, কুমারপুরের নবম শ্রেণির ছাত্র উত্তম প্রামাণিকেরা বলে, “বৃষ্টি হলেই বিদ্যুৎ লুকোচুরি খেলা শুরু করে। এই আছে তো ওই যায়। আমাদের পড়াশোনোর ক্ষতি হয়।”

অথচ রাজ্য সরকার এখন প্রায়ই দাবি করে থাকে এ রাজ্যের মানুষ ‘লোডশেডিং’ শব্দটাই ভুলে যাবেন। এ ক্ষেত্রে অন্তত ময়ূরেশ্বরবাসীর অভিজ্ঞতা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা স্বীকারই করে নিয়েছেন ওই এলাকার শাসক দলের পঞ্চায়েত প্রধান মিঠুদেবী এবং উপপ্রধান মনিরুদ্দিন খান। এমনকী, স্থানীয় বারগ্রামের বাসিন্দা তথা জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ জটিল মণ্ডলেরও স্বীকারোক্তি, “গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় গ্রামে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। তার পর আর সারা রাত আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। বেশ কিছু দিন ধরে দেখছি বৃষ্টি হলেই দীর্ঘ ক্ষণ বিদ্যুৎ উধাও হয়ে যাচ্ছে।” তিনি অবশ্য অবিলম্বে এ নিয়ে বিদ্যুৎ নিগমের সঙ্গে কথা বলবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। সেই আশ্বাসে অবশ্য ভুলতে নারাজ সিপিএমের ময়ূরেশ্বর জোনাল সম্পাদক অরূপ বাগ এবং বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল। তাঁদের দাবি, “অন্যান্য অনেক পরিষেবার মতোই বিদ্যুৎ পরিষেবা দিতেও এই সরকার ব্যর্থ। আসলে ওরা নিজের ঢাক পেটাতেই ব্যস্ত। তাই আসল সমস্যার দিকে ওদের নজর নেই।”

সংশ্লিষ্ট ময়ূরেশ্বর গ্রুপ ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের স্টেশন ম্যানেজার তথা অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার গঙ্গাধর মালি জানান, বাসুদেবপুরের ফিডারের লোকপাড়া শাখায় অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। বৈদ্যুতিক লাইন সংস্কার-সহ ওই বিদ্যুৎ সরবরাহ দেখভালের দায়িত্ব রয়েছে ঠিকাদারের উপর। তাঁর দাবি, ঠিক ভাবে সংস্কারের কাজ না হওয়াতেই ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। বিদ্যুৎ লাইনের পূর্ণাঙ্গ সংস্কারই শুধু নয়, সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ওই এলাকায় একটি নতুন সাব-স্টেশনের প্রয়োজন। তাঁর ব্যাখ্যা, “আসলে কোটাসুর সাব-স্টেশন থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূর পর্যন্তও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হয়। তাই সরবরাহকারী লাইনের উপর অত্যধিক চাপ পড়ে। তার জেরেই সমস্যা দেখা দেয়।”

গঙ্গাধরবাবুর দাবি অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার অশোক মণ্ডল। তাঁর পাল্টা দাবি, “এলাকায় বিদ্যুৎ পরিষেবা সচল রাখতে আমরা দিনরাত কাজ করি। তারপরেও আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উঠলে কিছু বলার নেই।”

কোম্পানির জেলা সুপারিনটেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়র তপনকুমার দে বলেন, “ময়ূরেশ্বর এলাকায় বিদ্যুৎ পরিষেবার এমন হালের কথা আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখছি।” তিনি আরও জানিয়েছেন, সাব-স্টেশনের শেষ প্রান্তে অবস্থানকারীদের ওই সমস্যা হলেও হতে পারে। পরিস্থিতির কথা ভেবে ওই এলাকায় নতুন একটি সাব-স্টেশন তৈরি করার ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE