জয়চণ্ডী দেবী।
ফাগুন শেষের বিকেলে শিয়ালদহ থেকে নৈহাটি লোকাল ঘণ্টাখানেকেই পৌঁছে দিল উত্তর ২৪ পরগনার কাঁকিনাড়ায়। সেখান থেকে গন্তব্য নারায়ণপুরের জয়চণ্ডীর সপ্তম দোলের মেলা। রবিবারের অলস বিকেলে ভিড়ভাড় নেহাতই কম। তাই স্টেশনে নেমে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়েই ব্রিজে উঠে হাঁটতে হাঁটতে রথতলা বাজার। সেখান থেকেই অটো, রিকশা বা টোটো ধরে অনায়াসে মিনিট সাতেকে পৌঁছনো যায় প্রাচীন এই মেলায়।
কিংবদন্তী অনুসারে, সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় ভবানী পাঠক উত্তরবঙ্গ থেকে নারায়ণপুরে এসে কিছু দিন আত্মগোপন করেছিলেন। সেই সময়কার এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী কালে এই মেলার সূচনা। এই মেলার প্রচলিত নাম হাঁড়ি-কলসির মেলা। আগে এক দিনের এই মেলায় পাওয়া যেত মাটির হাঁড়ি, কলসি, জালা আর নানা রকমের মাটির পুতুল। অদূরেই পালপাড়ায় এগুলি তৈরি হত। তবে মেলার সেই সাবেক ছবিটা বদলেছে। এখন মেলায় মাটির হাঁড়ি, কলসি বা মাটির পুতুলের নামগন্ধ নেই। হাল আমলের ছোট্ট একটা মেলা। আর পাঁচটা সাধারণ মেলার মতোই প্লাস্টিকের জিনিস, ছোটদের খেলনা, ইমিটেশন গয়না, ছোলাবাদাম ভাজা আর গরম গরম জিলিপিই ভরসা।
মেলার সেই সাবেক আকর্ষণ আজ না থাকলেও কিংবদন্তী আর বিশ্বাস আশ্রিত জয়চণ্ডীর মন্দিরের আকর্ষণে অসংখ্য মানুষ আজও এখানে ছুটে আসেন। এখন মেলা চলে দশ দিন। ছোট আটচালা মন্দিরটিতে সংস্কারের ছাপ স্পষ্ট। সামনের নাটমন্দিরটিও পরবর্তী কালের সংযোজন। তবে জয়চণ্ডীর ধাতুর ছোট বিগ্রহটি পুরনো তা বোঝা যায়। আবির, চন্দন আর নানা ফুলে অর্চিত দেবীমূর্তি প্রাচীন বাংলার ধাতুশিল্পের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
তবে দোল উত্সব মূলত বৈষ্ণবধর্মকে কেন্দ্র করে হলেও এই শাক্ত দেবীর সপ্তমদোল কেন?
এই মন্দিরের এক সেবায়েত মহাদেব মুখোপাধ্যায় বলছিলেন কিংবদন্তী এবং লোকমুখে প্রচলিত এই মন্দির সম্পর্কে নানা কথা। সেই কাহিনি অনুসারে, তখন বাংলায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। উত্তরবঙ্গ থেকে ভবানী পাঠক জঙ্গলে ভরা নারায়ণপুরে এসে আত্মগোপন করে কিছু দিন বসবাস করছিলেন। এক দিন সন্ধ্যায় তিনি দেখলেন, বহুমূল্য অলঙ্কারে সজ্জিতা এক নারী তার সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছেন পুকুরের দিকে। তিনি সেই অন্ধকার জঙ্গলে ভরা স্থানে এমন নারীকে দেখে চমকে উঠেছিলেন। তিনি সেই নারীকে দাঁড়াতে বলেন। কিন্তু ভবানী পাঠকের কথায় কোনও ভ্রক্ষেপ না করেই সেই নারী এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ভবানী তাঁকে পুনরায় দাঁড়াতে বললেও তিনি এগিয়ে গেলেন। এমনই এক সময় ভবনী পাঠক তাঁর তলোয়ার দিয়ে সেই নারীকে আক্রমণ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী সামনের পুকুরে মিলিয়ে গেলেন। ভবানী পাঠকও তাঁকে ধরার জন্য সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিলেন। কিন্তু সেই নারীর কোনও সন্ধান পেলেন না। বরং হাতে পেলেন একটি ছোট শিলাখণ্ড আর একটি ছোট দেবীবিগ্রহ। সেই দিনটি ছিল দোলযাত্রার ঠিক সাত দিন পরে কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী, যা সপ্তম দোল বলে পরিচিত। রাতে ভবানী পাঠক স্বপ্নে দেখেছিলেন সেই নারী আসলে দেবী মঙ্গলচণ্ডী বা জয়চণ্ডী। সেই থেকেই প্রচলন হল পুজোর। প্রথমে মন্দির ছিল না। গোলপাতার ঘরে রেখেই পুজো হত। পরবর্তী কালে তৈরি হয়েছিল বর্তমান মন্দির ও বড় বিগ্রহটি। তবে ভবানী পাঠকের পাওয়া সেই দুটি ছোট মূর্তি আজও থাকে সিংহাসনে ফুলে ঢাকা, যা সচরাচর বোঝা যায় না।
আগে বছরে এক দিন দেবীকে মন্দিরে এনে পুজো করা হত, সেই উপলক্ষেই বসত মেলা। এখন মেলার দিন বাড়ায়, দশ দিন দেবীকে মন্দিরে রাখা হয়। বছরের অন্য সময় তাঁকে রাখা হয় এক ভক্তের বাড়িতে। স্থানীয় বাসিন্দা মুকুল বিশ্বাস বলছিলেন, নিছক মেলার টানে নয়, এখানে আজও মানুষ আসেন বিশ্বাস আর ভক্তি নিয়ে। শোনা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একাধিক বার এই মন্দিরে এসেছিলেন।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy