আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ থেকে কথায়-কথায় লিখিত ভাবে রোগী রেফার করা হচ্ছে এসএসকেএমে!
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তো বটেই, নীলরতন মেডিক্যাল কলেজ থেকেও প্রায় প্রতিদিন পত্রপাঠ রোগী পাঠানো হচ্ছে এসএসকেএমে!
এমনকী ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজেরও রোগী রেফারের জায়গা সেই এক, এসএসকেএম!
ব্লক প্রাথমিক হাসপাতাল, জেলা, স্টেট জেনারেল বা মহকুমা হাসপাতাল থেকে রোগীকে কোনও মেডিক্যাল কলেজে উন্নততর চিকিৎসা পরিষেবার জন্য রেফার করা হলে তার একটা যুক্তিগ্রাহ্যতা থাকে। কিন্তু কলকাতা শহরের এক মেডিক্যাল কলেজ থেকে আর এক মেডিক্যাল কলেজে রোগী রেফারের কারণ কী? তা হলে কি ধরে নেওয়া হবে যে নামে মেডিক্যাল কলেজ হলেও কাজ বা মানের দিক থেকে কোনওটি উচ্চমানের আর কোনওটি নিম্নমানের? একটি মেডিক্যাল কলেজে যা যা পরিষেবা পাওয়া যায় অন্যটিতে তা মেলে না? এমন হলে সেটা তো রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলির ‘রেফারাল চেন’ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য দফতরের স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের কাছে এই প্রশ্ন তুলে অভিযোগ জানিয়েছেন এসএসকেএম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অভিযোগের সপক্ষে জমা দেওয়া হয়েছে রেফারের কাগজপত্রও। এসএসকেএমের সুপার করবী বড়ালের কথায়, ‘‘এমনিতেই আমাদের হাসপাতালে রোগীর চাপ সবচেয়ে বেশি। জনসাধারণের মনে একটা ধারণা গেঁথে রয়েছে যে, পিজি-তে ভর্তি হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তাতেই ভিড় সামলাতে নাভিশ্বাস উঠছে আমাদের। তার মধ্যে অন্য মেডিক্যাল কলেজগুলিও তাদের কাছে আসা রোগী পাঠিয়ে দিচ্ছে আমাদের কাছে।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘ওই মেডিক্যাল কলেজগুলিতে কি আমাদের চেয়ে পরিকাঠামো কম? ডাক্তার কম? তাহলে তাদের দায় আমরা নেব কেন? আমরা যদি সেই রোগী প্রত্যাখ্যান করতে যাই তা হলে আমাদের হাসপাতাল ভাঙচুর হবে!’’ এসএসকেএম কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, দুর্গাপুজোর ছুটির মধ্যেই অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজ থেকে এসএসকেএমে রোগী রেফারের হার শিখরে উঠেছিল।
রোগী রেফার করা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া নির্দেশ রয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর থেকে একাধিক বার লিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রেফারাল ব্যবস্থা নিয়ে। তাতে বলা হয়েছিল, একই গোত্রের হাসপাতালগুলির একটি থেকে অন্যটিতে রোগী রেফার করা যাবে না। করতে হলে লিখিত ভাবে কারণ জানিয়ে আগে থেকে সেই রোগী সম্পর্কিত তথ্য জানাতে হবে রেফারাল হাসপাতালকে, যাতে রেফার হয়ে সেখানে যাওয়ার পর রোগীর ভর্তিতে সমস্যা না হয়।
নির্দেশে আরও বলা ছিল, প্রত্যেক হাসপাতালকে রেফারাল রেজিস্টার রাখতে হবে। প্রত্যেক মাসে স্বাস্থ্য দফতরে তা জমা দিতে হবে। স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা তা যাচাই করে দেখবেন কোনও অপ্রয়োজনীয় রেফারাল হয়েছে কিনা। কিন্তু ঘোষণাই সার। স্বাস্থ্যভবনের কর্তারাই স্বীকার করছেন, অর্ধেক হাসপাতালেই নেই রেফারাল রেজিস্টার, বা থাকলেও নিয়মিত তাতে তথ্য লেখা হয় না এবং স্বাস্থ্যভবনও সেই খাতা পরীক্ষা করে না। ফলে যে যখন খুশি রোগী রেফার করে দায় এড়াচ্ছে।
যেমন, গত ৬ অক্টোবর ঘোলা মানিকডাঙা এলাকার বাসিন্দা পবন দে-কে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগ থেকে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ‘বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি’-র নিউরোসার্জারি বিভাগে জরুরি অস্ত্রোপচারের জন্য লিখিত ভাবে রেফার করা হয়। রোগীর বাড়ির লোক বাঙুরে যোগাযোগ করলে বাঙুর কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, আরজিকর-এ নিউরোসার্জারি রয়েছে। ফলে সেখান থেকে তাঁরা রোগী নেবেন না। সেই আরজিকর-ই দু’দিন বাদে ৮ অক্টোবর পবনবাবুকে ছেড়ে দেন এবং হাসপাতালের কাগজে লিখে দেন, রোগীকে পরে হাসপাতালের নিউরোমেডিসিন আউটডোর এবং ফিজিক্যাল মেডিসিন আউটডোরে দেখাতে হবে!
নথিতে প্রমাণ। (বাঁ দিকে) এনআরএস থেকে রেফার। (ডান দিকে) আরজিকর থেকে।
প্রশ্ন হল, আরজিকর-এ নিউরোসার্জারি থাকা সত্ত্বেও রোগীকে কেন বিআইএন-এ রেফার করা হল? রেফারের সময়ে যাঁর জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার দরকার বলা হল, দু’দিনের মধ্যে তাঁকে কেন বিনা অস্ত্রোপচারে ছেড়ে দেওয়া হল? নিউরোসার্জারির রোগীকে কেন নিউরোমেডিসিন ও ফিজিক্যাল মেডিসিনের আউটডোরে দেখাতে বলা হল?
আরজিকর-এর অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যালের কথায়, ‘‘আউটডোরে ওই রোগীকে কেন দেখাতে বলা হল বুঝতে পারছি না। তবে আরজিকর-এ এখনও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা জটিল অস্ত্রোপচার আমরা করতে পারছি না। কারণ লোকবলের অভাব। নিউরোসার্জারিতে ১ জন মাত্র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসার। বাকি সব আরএমও।’’ অথচ এই আরজিকর-এই মূলত মস্তিষ্ক ও শিরদাঁড়ার চোট-আঘাতের জন্য গত কয়েক বছর ধরে ট্রমাকেয়ার সেন্টার চালুর কথা বলে যাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর।
গত ১৫ অক্টোবর তারিখে শ্রীধর বিশ্বাস নামে ৫০ বছরের এক রোগীকে এনআরএস থেকে এসএসকেএম-এর কার্ডিওথোরাসিক বিভাগে রেফার করা হয়। গুরুতর আঘাতে তাঁর পায়ের মাংসপেশী-ধমনী কেটে গিয়েছিল। রেফারাল কাগজে নীলরতনের চিকিৎসক লিখে দিয়েছিলেন—‘এখানে কার্ডিওথোরাসিকের কোনও ইমার্জেন্সি হয় না ও প্লাস্টিক সার্জারির কোনও ইমার্জেন্সি হয় না!’ যা জানার পর নীলরতনের অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্যের উক্তি, ‘‘কিছু চিকিৎসকের ইমার্জেন্সি কেসের ব্যাপারে মানসিক বাধা রয়েছে। কেউ আবার স্রেফ ফাঁকিবাজির জন্য রোগী রেফার করেন। এটা চলতে পারে না। আমি তদন্ত করছি।’’
গত ১০ অক্টোবর পশ্চিম মেদিনীপুরের খোকন নাহাতা নামে ৩০ বছরের এক রোগীকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ রেফার করে এসএসকেএমের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে। কাগজে রেফারের কারণ হিসেবে লিখে দেয়—‘ফর বেটার ম্যানেজমেন্ট রেফার টু এসএসকেএম অর এনি আদার হসপিটাল।’ অথচ, মেডিক্যালে প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ দিব্যি মজুত। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকেও গত ২৫ সেপ্টেম্বর সুচিত্রা মণ্ডল নামে এক রোগীকে এসএসকেএমের প্লাস্টিক সার্জারিতে জরুরি সার্জারির জন্য রেফার করা হয়।
এমন উদাহরণ অজস্র। বিনা নজরদারিতে চলা এই অযৌক্তিক রেফারে সবচেয়ে বেশি হেনস্থা হচ্ছেন রোগী ও তাঁর বাড়ির লোক। কারণ চিকিৎসা শুরুর বদলে তাঁদের শুধু রেফার হয়ে পিংপং বলের মতো এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে হচ্ছে। রাজ্যজুড়ে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরির মাঝখানে মেডিক্যাল কলেজগুলির পরিষেবার সমতা আনতে কিছু করা যায় কি না, আপাতত সেই চিন্তারই তল পাচ্ছেন না স্বাস্থ্যকর্তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy