Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত পেরিয়ে ক্লান্ত রোহিঙ্গারা

পাহাড় ঘেরা গ্রাম ছিল তাদের। গ্রামের নাম ‘সাদুল্লাসসো।’ সকালে গরু-ছাগলগুলো মাঠে ছেড়ে জঙ্গল থেকে কাঠ নিয়ে আসত অঞ্জুনারা। বাড়ি ফিরে আরবি পড়া শেষ করেই ফুয়াইজমা (বান্ধবী) উমর আকিয়া-র সঙ্গে লুকোচুরি, হাডুডু, পুকুর দাপিয়ে স্নান। পান্তা ভাত আর শুঁটকি মাছ রাঁধতেন মা মাবিয়া খাতুন। মা-বাবা, সাত ভাই-বোনের জমাটি পরিবার।

নরেন্দ্রপুরের হোমে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন উমর ফজল। শনিবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

নরেন্দ্রপুরের হোমে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন উমর ফজল। শনিবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

পাহাড় ঘেরা গ্রাম ছিল তাদের। গ্রামের নাম ‘সাদুল্লাসসো।’ সকালে গরু-ছাগলগুলো মাঠে ছেড়ে জঙ্গল থেকে কাঠ নিয়ে আসত অঞ্জুনারা। বাড়ি ফিরে আরবি পড়া শেষ করেই ফুয়াইজমা (বান্ধবী) উমর আকিয়া-র সঙ্গে লুকোচুরি, হাডুডু, পুকুর দাপিয়ে স্নান। পান্তা ভাত আর শুঁটকি মাছ রাঁধতেন মা মাবিয়া খাতুন। মা-বাবা, সাত ভাই-বোনের জমাটি পরিবার।

তার পর এক দিন আগুন জ্বলল। সে কথা বলতে গিয়ে এখনও আতঙ্কের ছাপ বছর এগারোর অঞ্জুনারার মুখে। ‘‘বেজাতের মগরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল বাড়িঘর, খেত-খামারে। রণক্ষেত্র পরিস্থিতি। পুলিশও এসেছিল বন্দুক নিয়ে। বাচ্চাদের গুলি করে, বল্লম গেঁথে মেরে ফেলল ওরা। তলোয়ারে গলা কাটল কত। আমরা পিছনের দরজা দিয়ে পালালাম। আমার কোলে ছোট্ট ভাই মহম্মদ উসন।’’

টানা দশ দিন জঙ্গল-পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটেছিল অঞ্জুনারারা। খাবার জোটেনি সেই ক’দিন। কিন্তু সান্ত্বনা, তখনও সঙ্গে ছিলেন বাবা-মা। মায়ানমারের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ, সেখান থেকে ফের সীমান্ত পেরিয়ে ‘ইন্ডিয়া’য় ঢোকার পরেই বাবা-মা-দাদাকে জেলে নিয়ে গেল পুলিশ। ছোট্ট ভাইটাকেও ছিনিয়ে নিল কোল থেকে। তার পর আরও কিছু মেয়ের সঙ্গে অঞ্জুনারার ঠাঁই হল কলকাতায়, নরেন্দ্রপুরের সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হোমে।

ওই রোহিঙ্গা কিশোরীদের বয়স দশ থেকে ষোলোর মধ্যে। ভাষা দুর্বোধ্য, বার্মিজ ও চট্টগ্রামের মিশেল। এই ক’মাসে ওদের ক’জন ভাঙা বাংলা শিখেছে। সেটুকু কাজে লাগিয়ে আর আকার-ইঙ্গিতে বলছিল নিজেদের কথা। বছর পনেরোর সানোয়ারা জানাল, চোখের সামনে বাবার গলা কেটে দিয়েছিল জলপাই রঙের পোশাক পরা লোকগুলো। তার পর বড়দিকে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে গেল। সানোয়ারাকে নিয়ে পিছনে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটল মা, দাদি আর দাদা। গ্রাম জুড়ে তখন তরোয়াল, বল্লম, বন্দুক, চিৎকার, আগুন, ধোঁয়া। তেরো বছরের উমর ফজল চোখ মুছে বলল, ‘‘জলে বিষ মিশিয়ে বাচ্চাদের জোর করে খাইয়ে দিয়েছিল। ছোট ছোট শরীরগুলো পুড়িয়ে রাস্তায় টাঙিয়ে রেখেছিল। বাবা বলল, জান বাঁচাতে দেশ ছাড়তে হবে। পালালাম সবাই।’’

ত্রাসের ছায়া মেখে কথাগুলো বলছে বটে, কিন্তু ওদের প্রতিটা বাক্যেই অন্তত এক বার করে থাকছে ‘আমাদের বর্মা’-র কথা। দেশ হারিয়ে, তাড়া খেতে খেতে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একটু শান্তির আশ্রয় খুঁজে বেড়ালেও, ‘আমাদের’ দেশ কিন্তু এখনও বর্মাই। তাই এত আতঙ্কের দিনরাত্রি কাটিয়েও, একাধিক সীমান্ত পার করেও, শনিবারের তপ্ত দুপুরে কলকাতার হোমে বসে বারবার ফিরে আসে বড় প্রিয় সেই শব্দবন্ধ— ‘আমাদের বর্মা’।

মায়ানমারের রাখাইন এলাকায় জাতিদাঙ্গা তীব্র হতে শুরু করে ২০১৩ থেকে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসেবে এই দাঙ্গায় দেশছাড়া লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। নিখোঁজ ও খুন হয়েছেন কয়েক হাজার। সংখ্যাগুরু বার্মিজদের সঙ্গে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের এই অশান্তিতে মায়ানমার সরকার হাত ঝেড়ে ফেলে জানিয়েছিল, সে দেশের ১৩৫টি স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর তালিকায় রোহিঙ্গা নেই। ফলে, তাঁদের উপর হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকার বাধ্য নয়। যদিও রাষ্ট্রপুঞ্জের চাপে আগামী সপ্তাহে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈঠকে যোগ দিতে রাজি হয়েছে মায়ানমার।

এ রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, সীমান্ত পার হওয়ার সময় এঁদের অনেকে ধরা পড়েন। জেল খেটে বেরিয়ে শরণার্থী কার্ডের জন্য দিল্লিতে রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘কমিশন ফর রেফিউজি’ তে আবেদন জানাতে হয়। সেখান থেকে কার্ড পেলে তা দেখিয়ে হোম থেকে বাচ্চাদের বার করে তাঁরা রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী শিবিরে থাকতে পারেন। কিন্তু তা হলে জম্মু-কাশ্মীরে এত রোহিঙ্গা যাচ্ছেন কী করে? মুম্বই-হায়দরাবাদেও কিছু মানুষ গিয়েছেন। বাসুদেববাবুর কথায়, ‘‘জম্মু-কাশ্মীরকে এঁরা বেশ পছন্দ করেন। অনেকে বেআইনি ভাবেও যান সেখানে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন। তবে এ রাজ্যে যে-হেতু বেশ কিছু রোহিঙ্গা আসছেন, তাই খোঁজ রাখছি। দিল্লির সঙ্গে কথাও বলছি।’’

দেড়-দু’বছর ধরে আশ্রয়ের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছেন রোহিঙ্গারা। তাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, ভারতে আস্তানা নিতে পেরেছেন এই উপজাতির কিছু মানুষ। প্রাণ বাঁচাতে ছোট-ছোট নৌকায় আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছেন দশ হাজারের বেশি। কলকাতা ও আশপাশের বেশ কিছু হোমে এবং সংশোধনাগারে ২০১৩ সাল থেকেই এসেছেন বহু রোহিঙ্গা। এই মুহূর্তে সব চেয়ে বড় প্রশ্ন, কী হবে এই মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ? কোথায় যাবেন তাঁরা?

জাতিদাঙ্গাদীর্ণ রাখাইন থেকে সপরিবার এক-কাপড়ে ঘর ছেড়েছিল অঞ্জুনারা, নোরাঙ্কিস, সানোয়ারা, জুনজুন, রামিদা, রশিদা, সামিরার মতো অসংখ্য রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরী। সবাই ‘স্টেটলেস’, দেশহারা। তাড়া খেতে খেতে হাতড়ে বেড়াচ্ছে এক টুকরো ভূ-খণ্ড, এক টুকরো শান্তির আকাশ। একটা নিজের দেশ। যে দেশের জল-হাওয়া-মাটিতে মিশে নেই ঘর ছাড়ার আতঙ্ক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE