Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ভোট গোনা থেমে থাক

কমিশনের সিদ্ধান্তে রক্তচক্ষু শাসক দল

বিরোধীদের লাগাতার চাপের মুখে বিধাননগর, আসানসোল ও বালি পুর-এলাকার ভোটের গণনা আপাতত স্থগিত রাখল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। সাম্প্রতিক কালে এমন সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন। শনিবারের ভোট যে অবাধ হয়নি, কমিশনের সিদ্ধান্তে তা-ই কার্যত মেনে নেওয়া হল বলে বিরোধীদের দাবি।

বুথে বহিরাগত দেখে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রীতিকুমার সেন। ‘অপরাধের মাসুল’ দিতে সাতসকালেই ৬৭ বছরের বৃদ্ধকে রাস্তায় ফেলে চলল বেধড়ক মারধর। শনিবার সল্টলেকে। — নিজস্ব চিত্র

বুথে বহিরাগত দেখে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রীতিকুমার সেন। ‘অপরাধের মাসুল’ দিতে সাতসকালেই ৬৭ বছরের বৃদ্ধকে রাস্তায় ফেলে চলল বেধড়ক মারধর। শনিবার সল্টলেকে। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

বিরোধীদের লাগাতার চাপের মুখে বিধাননগর, আসানসোল ও বালি পুর-এলাকার ভোটের গণনা আপাতত স্থগিত রাখল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। সাম্প্রতিক কালে এমন সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন। শনিবারের ভোট যে অবাধ হয়নি, কমিশনের সিদ্ধান্তে তা-ই কার্যত মেনে নেওয়া হল বলে বিরোধীদের দাবি।

বিধাননগর ও আসানসোল পুর-নিগম এবং হাওড়া পুর-নিগমের মধ্যে বালি এলাকার পুরভোটের নামে শনিবার প্রহসন চলেছিল বলে বিরোধীদের অভিযোগ। তিনটি এলাকার ভোটই বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন করানোর দাবিতে শনি ও রবিবার কমিশনের দফতরে ধর্নায় বসে বিজেপি, বাম ও কংগ্রেস। এর পরেই এ দিন সন্ধ্যায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় জানিয়েছেন, পুরভোট নিয়ে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত বুধবার পূর্বনির্ধারিত ভোট-গণনা স্থগিত রাখা হচ্ছে। তবে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ এবং পঞ্চায়েতের ত্রিস্তরে তিনশোর বেশি আসনের গণনা বুধবারই হবে। যদিও মাটিগাড়ার দু’টি বুথে আজ, সোমবার ফের ভোট নেওয়ার নির্দেশ জারি হয়েছে।

কমিশনের ঘোষণার প্রেক্ষিতে জল্পনা শুরু হয়েছে— তিনটি এলাকার গোটা নির্বাচনই কি বাতিল করে দেওয়া হতে পারে? কমিশনার বলেন, ‘‘আমার হাতে সংবিধানের ২৪৩ জেড (এ) ধারায় ক্ষমতা রয়েছে। সেই ক্ষমতার বলেই গণনা স্থগিত রাখলাম। পুরো ভোটই বাতিল হবে কি না, তা অভিযোগ খতিয়ে দেখার পরেই বলব।’’ রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের হাতে সংবিধানের ওই ধারা বলে যে বিশেষ ক্ষমতা আছে, তা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ওই পদে কাজ করে তৃণমূল সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানো মীরা পাণ্ডে। তবে সুশান্তবাবুর জমানায় সেই ধারা প্রয়োগ শাসক ও বিরোধী, দুই শিবিরের কাছেই অপ্রত্যাশিত!

রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে আসছেন
লকেট চট্টোপাধ্যায়, রূপা গঙ্গোপাধ্যায় ও জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

সুশান্তবাবুর ‘অপ্রত্যাশিত’ সিদ্ধান্ত জানার পরেই কমিশনের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে উঠেছে শাসক দল! বিরোধীদের ধর্নার চাপে এবং রাজ্যপাল ও কমিশনের ‘চক্রান্তে’ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে ফুঁসে উঠেছে তারা! কিন্তু রাজ্যপাল কেশরানীথ ত্রিপাঠী কেন? তিনি এ দিন ভোট নিয়ে প্রকাশ্যে এমনি কোনও মন্তব্য না করলেও ভোটের দিন সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘‘রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উচিত বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা। সব যাচাই করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া।’’ তৃণমূলের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, ভোটের আগে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে কেন্দ্রকে চিঠি পাঠিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। ভোটের দিন প্রবল অশান্তির ঘটনায় শাসক দলের মুখ পোড়ার পরে এখন রাজ্যপাল ও বিজেপি-র সঙ্গে কমিশনকেও কাঠগড়ায় তুলে নজর ঘোরানোর চেষ্টা হচ্ছে। যে কৌশল নিয়ে দলের অন্দরে ভিন্ন মতও আছে!

কমিশনের কাছে রাজ্যপাল কি কিছু জানতে চেয়েছেন? সুশান্তবাবু এ নিয়ে সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন। শুধু বলেছেন, ‘‘সাংবিধানিক দিক থেকে ভোট নিয়ে রাজ্যপালকে রিপোর্ট দিতে কমিশন বাধ্য নয়। ওঁকে এ রকম রিপোর্ট কমিশন পাঠাবে কি না, তা নিয়ে হ্যাঁ বা না এখনই বলছি না। বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে।’’

গণনা স্থগিতের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আজ, সোমবার সকাল থেকে কলকাতার সব দলীয় কাউন্সিলরকে নিয়ে কমিশনের দফতরে ধর্না দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজ্যপাল, কমিশন যতই চক্রান্ত করুন, তাঁরা এক্তিয়ার বহির্ভূত কাজ করলে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ ঐক্যবদ্ধ ভাবে তার প্রতিবাদ করবেই।’’ তার পরেই তিনি বলেন, ‘‘বিরোধীদের চাপে যদি গণনা স্থগিত থাকে, আমরাও তা হলে তার প্রতিবাদে কমিশনে গিয়ে অবস্থানে বসব!’’

বস্তুত, রাতে তৃণমূলের তরফে পার্থবাবু ফের যে লিখিত বিবৃতি জারি করেন, তা আরও কড়া। সেখানে বলা হয়েছে, ‘রাজভবন কি বিজেপি-র দলীয় কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে? রাজ্যপালের ভূমিকা তাঁর সম্মাননীয় পদমর্যাদার সঙ্গে মানানসই নয়। এই প্রথম এই ধরনের ঘটনা ঘটছে।’ তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনও বিবৃতিতে বলেছেন, ‘রাজ্যপালেরা নোংরা রাজনীতি শুরু করলে তা দুর্ভাগ্যজনক’! পার্থবাবুর বিবৃতিতে নির্বাচন কমিশনকেও নিশানা করে বলা হয়েছে, ‘বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি একটা বিবৃতি দিচ্ছেন আর নির্বাচন কমিশনার সে কথার পুনরাবৃত্তি করছেন’!

নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের সূত্রপাত এ দিন বিকাল থেকে। শনিবার রাত পর্যন্ত ধর্না চালিয়েছিলেন বিজেপি ও বাম নেতারা। সুশান্তবাবু এ দিন বিকালে আবার তাঁদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানিয়েছিলেন। সেই মতোই এ দিন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে যান বিজেপি নেতারা। আলোচনা সেরে বেরিয়ে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘আমরা বলেছিলাম, হয় ভোট অবৈধ ঘোষণা করুন, নয়তো গণনা বন্ধ রাখুন। আমাদের দাবি মেনে কমিশনার দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। এর পরে তিনি তদন্ত করে বাকি সিদ্ধান্ত নেবেন। এই ঐতিহাসিক এবং বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তের জন্য কমিশনারকে ধন্যবাদ।’’ একই সঙ্গে রাহুলবাবুর দাবি, ভোট গণনা না হওয়া পর্যন্ত যে সব স্ট্রং রুমে ইভিএম রাখা আছে, সেগুলিতে ইএফআর বা এসএসবি-র পাহারা বসাতে হবে। কমিশনের প্রতিনিধিদের দিয়ে দিনে দু’বার স্ট্রং রুম পরীক্ষা করাতে হবে।

পরে সন্ধ্যায় সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘আমাদের একটা সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখলাম, একটি লোক বুথের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভোটারকে কোথায় ভোট দেবে নির্দেশ দিচ্ছে।’’ এমন আরও কিছু ফুটেজ কমিশনের কাছে রয়েছে। এসএমএস এবং ফোনেও একাধিক অভিযোগ এসেছে। ফোনের অভিযোগগুলি রেকর্ড করা হয়েছে। সব অভিযোগই খতিয়ে দেখা হবে। প্রথমে রাহুলবাবুর মন্তব্য এবং তার পরে সুশান্তবাবুর ঘোষণা শুনেই ক্ষুব্ধ হয়েছে শাসক দল। একটি সূত্রের খবর, বিজেপি-র পরে বামফ্রন্টের প্রতিনিধিরা এ দিন যখন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখনই তাঁর ফোনে তৃণমূলের শঙ্কুদেব পণ্ডার ফোন আসে। ভোট গণনার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে কমিশনারকে প্রশ্ন করেন শঙ্কু। পরে মহাসচিব পার্থবাবু ওই সিদ্ধান্তের জন্য সুশান্তবাবুর বিরুদ্ধে তোপ দাগেন। পার্থবাবুর যুক্তি, আসানসোল এবং বালির যে সব মানুষ ভোট দিয়েছেন, ভোট গণনা স্থগিত রাখলে তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হয়!

গণনা স্থগিতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও বিরোধীদের মধ্যে অবশ্য সংশয় আছে। কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান যেমন বলেছেন, ‘‘এটা গট আপ গেম নয় তো? খতিয়ে দেখে তার পরে কমিশন তো বলতেই পারে, অভিযোগের সারবত্তা পাওয়া যায়নি। তাই ভোট বহাল থাকছে!’’ কয়েক মাস আগে কলকাতা পুরসভার ভোটের সময়েই বিরোধীদের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভূরি ভূরি অভিযোগ সত্ত্বেও তখন কোথাও পুনর্নির্বাচনের আদেশ হয়নি। এ বারও কি একই ফল হতে পারে? সুশান্তবাবুর জবাব, ‘‘আমি তো বলেছি, ভোট গণনা স্থগিত করা হল। সবটা আগে খতিয়ে দেখি!’’

কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে সিপিএম নেতা রবীন দেব এ দিন বলেন, ‘‘এটা নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে তৃণমূলের দুই বিধায়ক সুজিত বসু ও অর্জুন সিংহ এবং তৃণমূলের প্রার্থী অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছি। বলেছি, গোয়েন্দাপ্রধান কঙ্করপ্রসাদ বারুই ও বিধাননগর (দক্ষিণ) থানার আইসি সুরজিৎ দে-কেও গ্রেফতার করতে হবে।’’ কংগ্রেসের দেবব্রত বসুও কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন। আর প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘শনিবারই কমিশনারকে বলেছিলাম, কয়েকটি বুথে পুনর্নিবার্চন করে লাভ নেই। পুরো ভোট বাতিল করে নতুন করে ভোট করতে হবে। সেই দাবির ফলেই কমিশনার গণনা স্থগিত রেখেছেন।

কমিশন জানিয়েছে, সব অভিযোগের পাশাপাশি খতিয়ে দেখতে হবে প্রিসাইডিং অফিসারের রিপোর্ট এবং পোলিং অফিসারের ডায়েরি। যে সব টিভি চ্যানেল ভোটে উপস্থিত ছিল, তাদের কাছ থেকেও ‘আনএডিটেড ফুটেজ’ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। জেলাশাসকদের কাছ থেকেও ভিডিও ফুটেজ এবং রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘সবটা তো আমার হাতে নেই। তাই চেয়ে পাঠাতে হচ্ছে। সেগুলি খতিয়ে দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’ এখনও পর্যন্ত যে বিজ্ঞপ্তি রয়েছে, তাতে এই ভোটপর্ব ১৬ অক্টোবরের মধ্যে শেষ করার কথা। সে ক্ষেত্রে গণনা কত দিন স্থগিত রাখা সম্ভব? সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘প্রয়োজনে আমি গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে সময় বাড়িয়ে নেব।’’ বিরোধীদের একাংশের অভিযোগ, ভোট অবাধ না হওয়ার দায় কমিশনারকেও নিতে হবে। তিনি যথার্থ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এ ব্যাপারে সুশান্তবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। পেরেছি না পারিনি, তা নিয়ে সরাসরি কিছু বলতে চাই না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE