বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ঘটনাস্থল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা ভবন। ভবনের যে দরজা দিয়ে উপাচার্য, রেজিষ্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ামকেরা যাতায়াত করেন সেই সংরক্ষিত এলাকা দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ৭০-৮০ জনের একটা দল। হাতে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি-র পতাকা। নেতৃত্বে টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা। নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে দোতলায় গিয়ে সিন্ডিকেট রুমের বাইরে গিয়ে বসে পড়ল দলটি। শুরু হয়ে গেল স্লোগান। কখনও হাততালি দিয়ে গান। ঘরের ভিতরে তখন চলছে সিন্ডিকেটের বৈঠক।
এর কিছু ক্ষণ আগেই বর্ধমানের ঝিঙ্গুটির মাঠে এক জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “ছাত্রদের সংযত হতে হবে। ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখিয়ে দাবিদাওয়া আদায় করা চলবে না।”
মুখ্যমন্ত্রীর এই কথা তাঁরই দলের ছাত্র সংগঠনের প্রধানের কান পর্যন্ত পৌঁছেছে কি না সন্দেহ। কারণ, শঙ্কু তত ক্ষণে ‘আন্দোলনে’ সরগরম করে তুলেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদর দফতর। যে জঙ্গিপনা দেখে চমকে উঠেছে শিক্ষকমহলের একটি বড় অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকদের অনেকেরই মনে পড়েছে সত্তরের দশকের কথা। পরে বামফ্রন্ট আমলেও বিভিন্ন সময়ে ছাত্র আন্দোলন শৃঙ্খলার মাত্রা ছাড়িয়েছে। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র ছাত্র-রাজনীতির নামে যে ভাবে লাগামহীন বেপরোয়া কার্যকলাপ চলেছে, তা শিক্ষকদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, নিরাপত্তা চাইতে কলেজ ছেড়ে শিক্ষকদের একাংশকে এ দিন ছুটে আসতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদর দফতরে। বসতে হয়েছে ধরনায়।
তবে দ্বারভাঙা ভবনে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। গত তিন দিন ধরে এই আন্দোলনেই ত্রস্ত থেকেছে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ। ঘটনার সূত্রপাত সোমবার। সেখানে শারীরবিদ্যা বিভাগের শিক্ষিকা, বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মেয়ে রোশেনারা মিশ্রের বিরুদ্ধে টিএমসিপি অভিযোগ করে, তিনি বহিরাগতদের এনে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করছেন। সেই অভিযোগে সে দিন রোশেনারাদেবী ও ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের দু’ঘণ্টা ঘেরাও করে রেখেছিলেন টিএমসিপি-র নেতারা। রোশেনারাদেবী টিএমসিপি-র অভিযোগ অস্বীকার করেন। টিএমসিপি-র ঘেরাওয়ের প্রতিবাদে এবং নিরাপত্তার দাবিতে ওই বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা মঙ্গলবার ক্লাস বয়কট করেন।
বুধবার ক্লাস চলাকালীন টিএমসিপি-র একদল সমর্থক তাঁদের ভয় দেখান বলে অভিযোগ জানিয়ে অবস্থান বিক্ষোভ করলেন শারীরবিদ্যার ছাত্রছাত্রী, রিসার্চ স্কলারেরা। এর পরেই পাল্টা বিক্ষোভে সামিল হয় টিএমসিপি। তাদের জঙ্গিপনা দেখে ছাত্রছাত্রী ও রিসার্চ স্কলারেরা বিভাগীয় প্রধানের কাছে নিরাপত্তার দাবিতে চিঠি দেন। না হলে তাঁরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস ও গবেষণার কাজ বন্ধ করে দেবেন বলেও জানিয়ে দেন।
এর পরের ঘটনাস্থল দ্বারভাঙা ভবন। বিকেলে তার সামনে নিরাপত্তার দাবিতে অবস্থানে বসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন কুটা-র এক দল সদস্য। ভিতরে তখন শুরু হয়েছে সিন্ডিকেটের বৈঠক। বৈঠক শুরু হওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের কাছে নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে এসেছেন কুটার প্রতিনিধিরা। ওই অবস্থান বিক্ষোভের মধ্যেই রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে প্রবেশ শঙ্কুদেব পণ্ডার।
শঙ্কুরা যে ভাবে কোনও বাধা ছাড়াই দোতালায় উঠে গেলেন, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকদের অনেকেই। প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন শঙ্কুদের সামান্য বাধাটুকুও দিলেন না? কেনই বা পুলিশ ডেকে সংরক্ষিত এলাকা থেকে সরিয়ে দিলেন না বিক্ষোভকারীদের? উপাচার্য সুরঞ্জন দাস বলেছেন, “আমরা ছাত্র-শিক্ষক দু’তরফেরই কথা শুনেছি। বিষয়টি দেখা হচ্ছে।”
সিন্ডিকেট রুম পর্যন্ত কেন মিছিল নিয়ে গেলেন শঙ্কুদেব? টিএমসিপি নেতৃত্বের অভিযোগ, সিন্ডিকেট বৈঠকে বহিগারগত ঢুকে পড়েছেন। তাঁকে বাইরে বের করে দিতে হবে। সিন্ডিকেটের বৈঠক বাতিল করতে হবে। কে সেই বহিরাগত? টিএমসিপি-র আঙুল রোশেনারাদেবীর দিকে। যদিও রেশোনারা সিন্ডিকেট বৈঠকে ঢোকেননি। তিনি কুটার সদস্যদের সঙ্গে অবস্থান আন্দোলন করছিলেন দ্বারভাঙা ভবনের নীচে।
শঙ্কু বহিরাগত নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন রোশেনারাদেবীর বিরুদ্ধে। কিন্তু দ্বারভাঙা ভবনে যে দল নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন, সেখানেও বহিরাগতের সংখ্যা কম ছিল না। আমহার্স্ট স্ট্রিট, ক্রিক রো অঞ্চলের তৃণমূল নেতা চিনু হাজরা, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় (কান-কাটা দেবু)-র মতো কয়েক জন যাঁরা গত বছর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার ঘটনার অভিযুক্ত, এ দিন তাঁরাই শঙ্কুর পাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছেন। শঙ্কু বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে কত লোকই তো কত দরকারে আসেন। কে কখন এসেছেন আমি জানি না।” শঙ্কু নিজেই তো বহিরাগত। তিনিই বা ঢুকলেন কেন? টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতির দাবি, “আমি ছাত্র সংগঠন করি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। ট্রেড ইউনিয়ন করলে পুরসভার গেটে যেতাম।”
ঘটনার অভিঘাত পৌঁছয় শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত। তিনি বলেন, “ঘেরাও থেকে দূরে থাকার জন্য আমি সব ছাত্র সংগঠনকে অনুরোধ করব।” কিন্তু শঙ্কুদেব সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য কী? পার্থবাবুর বক্তব্য, “আমি শঙ্কুকে ডেকে পরিষ্কার জানিয়েছি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘেরাও চলবে না। কিন্তু ওরা সিন্ডিকেট ঘেরাও করেনি। আমি খোঁজ নিয়েছি, ওরা সিন্ডিকেটের বাইরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে।”
ছাত্র আন্দোলনের এই চেহারায় কিন্তু রাজ্যের প্রাক্তন ছাত্র নেতারা অনেকেই ব্যথিত। রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “ছাত্র রাজনীতি সব সময়েই ছাত্রস্বার্থে হয়। তবে সেটা কখনওই শিক্ষক সমাজকে আঘাত বা অসম্মান করে হওয়াটা বাঞ্ছনীয় নয়।” সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক তথা প্রাক্তন ছাত্রনেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, “এ তো বাহাত্তরের কালো দিনগুলির চেয়েও ভয়ঙ্কর! এটা মুখ্যমন্ত্রী বুঝবেন কি না, জানি না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy