Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বদলাবে সময়, আশায় দিন গুনছেন শৌভিক

লাঠিতে ভর করে দু’পা হাঁটলেই পা টলে। যন্ত্রণায় বেঁকে যায় মুখ। তবুও চোয়াল শক্ত করে চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বছর পঁচিশের শৌভিক চট্টোপাধ্যায়। তবে পাঁচ বছর আগেও পরিস্থিতি এমনটা ছিল না। মৌলালির ফ্ল্যাটে বাবা, মা ও দিদিকে নিয়ে ভালই কেটে যাচ্ছিল চার জনের সংসার।

নিজের বাড়িতে শৌভিক চট্টোপাধ্যায়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

নিজের বাড়িতে শৌভিক চট্টোপাধ্যায়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৫ ০৩:১৯
Share: Save:

লাঠিতে ভর করে দু’পা হাঁটলেই পা টলে। যন্ত্রণায় বেঁকে যায় মুখ। তবুও চোয়াল শক্ত করে চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বছর পঁচিশের শৌভিক চট্টোপাধ্যায়।

তবে পাঁচ বছর আগেও পরিস্থিতি এমনটা ছিল না। মৌলালির ফ্ল্যাটে বাবা, মা ও দিদিকে নিয়ে ভালই কেটে যাচ্ছিল চার জনের সংসার।

সেটা ২০০৮ সাল। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন শৌভিক। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে যখন তিনটে সেমেস্টারের পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, হঠাৎ-ই এক দিন বিকেলে শৌভিকের বাবা সুনীল চট্টোপাধ্যায় একটি ফোন পান, ‘‘তাড়াতাড়ি আসুন, শৌভিক হাসপাতালে।’’ পেশায় কলকাতা পুরসভার কর্মী সুনীলবাবু মেয়ে সোমদত্তাকে সঙ্গে নিয়ে উড়ে যান বেঙ্গালুরু। হাসপাতালে শৌভিক তখন কোমায়। ছেলের বন্ধুদের থেকে সুনীলবাবু জানতে পারেন, আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন শৌভিক। তবে কেন এমন চরম পদক্ষেপ করল ছেলে, তার সদুত্তর মেলেনি কারও কাছ থেকেই। বন্ধুদের মধ্যেই কেউ কেউ আবার জানিয়েছিলেন, অসাবধানতায় দোতলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়েই শৌভিকের এমন অবস্থা।

পরের এক মাস হাসপাতালে যমে-মানুষে টানাটানি। ভেন্টিলেশন থেকে শৌভিককে যখন বার করে আনা হল, তখন মুখে কোনও কথা নেই। বেঁকে গিয়েছে হাত-পা। শূন্য দৃষ্টি, চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। দু’মাসের মাথায় বেঙ্গালুরুর হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে ছেলেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন সুনীলবাবু। জড় পদার্থের মতো বিছানায় পড়ে শৌভিক। তবে সামনে কাউকে দেখলে যেন কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু শোনা যেত কেবল অস্ফুট গোঙানি। এ ভাবেই কেটে গিয়েছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তবে চিকিৎসায় সাড়া মিলেছিল। ভেলোরেও নিয়ে যাওয়া হয় শৌভিককে। এত সব করতে প্রায় ৯০ লক্ষ টাকা খরচ হয়ে যায় সুনীলবাবুর। শৌভিকের মা-ও ক্যানসারের রোগী। দু’জনের চিকিৎসার খরচ জোগাতে ঋণের অঙ্ক বাড়ে সুনীলবাবুর।

ঘটনার সাত মাস পরে, ল্যাপটপ খুলে এক যুবকের ছবি দেখান শৌভিক। তবে কী বলতে চাইছেন, বাড়ির কেউ তা বুঝতে পারেননি। সেটুকু বুঝতে আরও এক মাস সময় লাগল, যখন জড়ানো গলায় শৌভিক বললেন, ‘‘আমাকে ফেলে দিয়েছে।’’

ধীরে ধীরে শৌভিকের কথা কিছুটা স্পষ্ট হয়। তাতেই জানা যায়, দুর্ঘটনার কিছু দিন আগে তাঁর সহপাঠী, গুয়াহাটির শশাঙ্ক দাস তাঁর ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করেন। শৌভিকের দিদির কথায়, ‘‘মাঝে-মধ্যেই মদ-গাঁজা খাওয়ার জন্য ভাইকে জোরাজুরি করত শশাঙ্ক। পানশালায় নিয়ে যেতে চাইত। ভাই এ সবের থেকে দূরে থাকত। আর তা নিয়েই সমস্যার শুরু।’’ শৌভিকের দিদি জানান, শৌভিক শশাঙ্ককে অন্যত্র চলে যেতে বলেন। শশাঙ্ক চলেও যান। অভিযোগ, ঘটনার দিন, ২০১০-এর ৬ ডিসেম্বর সকালে শৌভিকের বাড়ির ছাদে যান শশাঙ্ক। ‘অন্য বন্ধুরাও আছে’ বলে ডেকে পাঠান শৌভিককে। শৌভিক গিয়ে দেখেন সেখানে শশাঙ্ক একা। বচসা হয় দু’জনের। শৌভিক চড় মারেন শশাঙ্ককে। এমন সময় আশপাশে লুকিয়ে থাকা আরও তিন যুবক বেরিয়ে এসে মারধর শুরু করে শৌভিককে। শৌভিকের অভিযোগ, লোহার রড দিয়ে বেধড়ক মারা হয় তাঁকে। তার পরে দোতলার ছাদ থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়।

ঘটনাটি ঘটেছিল বেঙ্গালুরুর আভালহালি থানা এলাকায়। সাত মাস পরে শৌভিকের কাছ থেকে এই ঘটনা শুনে সেই থানায় চিঠি পাঠিয়ে লিখিত ভাবে অভিযোগ জানান সুনীলবাবু। বেঙ্গালুরুর পুলিশ কলকাতায় এসে শৌভিকের বয়ান নেয়। শৌভিকের বন্ধুদের কাছ থেকে সুনীলবাবুরা জানতে পারেন, শশাঙ্ক অসমে চলে গিয়েছে। এখনও তাঁকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

বেঙ্গালুরু পুলিশের এক কর্তা আব্দুল আহাদ জানান, গোটা ঘটনায় শশাঙ্কই মূল দোষী। ইতিমধ্যেই তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। আদালত শশাঙ্কের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। চলতি মাসেই অসম যাবে বেঙ্গালুরু পুলিশের একটি দল।

দিন গুনছেন শৌভিক। তাঁর জীবন থেকে পাঁচটা বছর কেড়ে নেওয়ার জন্য শাস্তি চান শশাঙ্কের। সেই সঙ্গে পড়াটাও শেষ করে নিতে চান তিনি। এখন বাড়িতে বসেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের করেসপন্ডেন্স কোর্স পড়ছেন শৌভিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE