Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সাফল্যের প্লাবনে ভর্তির তরী বাঁচানোই চ্যালেঞ্জ

টক্করটা সর্বভারতীয় জোড়া বোর্ড আইসিএসই এবং সিবিএসই-র সঙ্গে। নম্বরের প্রতিযোগিতায় তাদের প্রায় সমকক্ষ হয়ে উঠলেও উচ্চ মাধ্যমিকের সেই সাফল্য সঙ্গে নিয়ে এসেছে অন্য দুর্ভাবনা। পছন্দের কলেজে ঠাঁই হবে কি না, দুশ্চিন্তা এখন সেটাই। আইসিএসই, সিবিএসই-র মতো সর্বভারতীয় বোর্ডের দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় নম্বরের দৌড়ে বরাবরই পিছিয়ে পড়তেন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা। এটা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিলকুল নাপসন্দ। মূলত তাঁর মন রাখতেই উচ্চ মাধ্যমিকে প্রশ্নপত্রের ধরন আমূল বদলে ফেলেছে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ। শুক্রবার উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পরে দেখা যাচ্ছে, পড়ুয়াদের প্রাপ্ত নম্বর, পাশের হার সবই বেড়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

টক্করটা সর্বভারতীয় জোড়া বোর্ড আইসিএসই এবং সিবিএসই-র সঙ্গে। নম্বরের প্রতিযোগিতায় তাদের প্রায় সমকক্ষ হয়ে উঠলেও উচ্চ মাধ্যমিকের সেই সাফল্য সঙ্গে নিয়ে এসেছে অন্য দুর্ভাবনা। পছন্দের কলেজে ঠাঁই হবে কি না, দুশ্চিন্তা এখন সেটাই।

আইসিএসই, সিবিএসই-র মতো সর্বভারতীয় বোর্ডের দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় নম্বরের দৌড়ে বরাবরই পিছিয়ে পড়তেন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা। এটা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিলকুল নাপসন্দ। মূলত তাঁর মন রাখতেই উচ্চ মাধ্যমিকে প্রশ্নপত্রের ধরন আমূল বদলে ফেলেছে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ। শুক্রবার উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পরে দেখা যাচ্ছে, পড়ুয়াদের প্রাপ্ত নম্বর, পাশের হার সবই বেড়েছে। সর্বোচ্চ নম্বরের দৌড়ে আইএসসি, সিবিএসই-কে ছুঁয়ে ফেলেছে এ রাজ্যের উচ্চ মাধ্যমিক। পাশের হার গত বারের থেকে চার শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮২.৩৮। উচ্চ মাধ্যমিকের ইতিহাসে এটা রেকর্ড। আগামী দিনে পাশের হারও দিল্লি বোর্ডের মতো ৯০ শতাংশ টপকে যাবে বলে শিক্ষা শিবিরের ধারণা।

কিন্তু এই সাফল্যের মধ্যেও খচখচ করে ফুটছে কলেজে ঠাঁইয়ের ব্যাপারে দুশ্চিন্তার কাঁটা। ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর পেয়েও পছন্দমতো কলেজে ভর্তির সুযোগ মিলবে কি না, পডুয়াদের সামনে এখন বড় প্রশ্ন সেটাই। কলেজ ও আসনের অভাব সোজাসাপ্টা পরিসংখ্যানের দিক থেকেও সেই দুর্ভাবনার পাল্লা ভারী করছে। উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যে সাধারণ ডিগ্রি কলেজের সংখ্যা ৪৬৩। আসন মেরেকেটে ৮০ হাজার। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আসন ৩০ হাজারের কিছু বেশি। ডাক্তারির আসন ২৭০০। এ ছাড়া বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, আইন, পলিটেকনিক ইত্যাদি মিলিয়ে আসন হাজার পঞ্চাশ। অথচ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন ৫,৪৫,৮৪৪ জন। তাঁদের মধ্যে ২,৩৫,২৬০ জন পেয়েছেন ৬০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর। এত সফল পড়ুয়া ভর্তি হবেন কোথায়? ৮৫-৯০ শতাংশ নম্বর পেয়েও পছন্দের প্রতিষ্ঠানে পছন্দের বিষয়ে ভর্তির সুযোগ মিলবে না বলেই আশঙ্কা করছেন অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা।

সফল সব ছাত্রছাত্রী পছন্দমাফিক ভর্তির সুযোগ পাবেন কি?

উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ আশাবাদী। সংসদের সভানেত্রী মহুয়া দাস এ দিন বলেন, ‘‘আইএসসি, সিবিএসই-তে তো প্রতি বছরই এমন নম্বর ওঠে। এ বার উচ্চ মাধ্যমিকেও উঠল। অন্যান্য বার যেমন কলেজে ছাত্র ভর্তি হয়, এ বারেও হবে। অসুবিধা কোথায়?’’

কিন্তু আসন-সংখ্যাই তো অত নয়। স্থান সঙ্কুলান হবে কী ভাবে?

উচ্চশিক্ষা দফতরের ব্যাখ্যা, প্রতি বছরই কিছু আসন বাড়ানো হয়। তা ছাড়া এ বার ২৬টি নতুন সরকারি কলেজ খোলা হয়েছে। তাই ছাত্র ভর্তি নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হবে।

এতেও প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ সফল ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সকলেরই কলেজে ভর্তি সম্ভব হবে বলে মনে করছে না শিক্ষা শিবির। তা হলে শিক্ষা দফতর বা সংসদ চিন্তামুক্ত হচ্ছে কী করে?

একটি কলেজের অধ্যক্ষ জানান, যত ছাত্রছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন, তাঁদের অনেকেই স্নাতকে ভর্তি হন না। অনেকে বাইরে পড়াশোনা করতে চলে যান। বাকিরা যে যেমন সুযোগ পান, পড়াশোনা করেন। ‘‘এ বারেও তেমনটাই হবে। সংসদ আর দফতরও তাই নিশ্চিন্ত। ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কোনও উদ্বেগ নেই,’’ বললেন ওই অধ্যক্ষ।

উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের দেওয়া তথ্য অনুসারে এ বারের পরীক্ষায় নম্বরের নিরিখে ৯০ থেকে ১০০% বা ‘ও’ গ্রেড পাওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যাই ২,৭১০। গত বার যেটা ছিল মাত্র ৭১০। ৮০-৮৯% নম্বর বা ‘এ+’ গ্রেড পেয়েছেন ৩১,৫২১ জন। গত বার যে-সংখ্যাটা ছিল ১২,০০৩। ৮০%, ৯০% নম্বর পাওয়া ছেলেমেয়ের সংখ্যা এই হারে বেড়ে যাওয়ায় ভাল ভাল কলেজে ভর্তির জন্য হুড়োহুড়ি যে পড়বেই, তাতে সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় কলেজগুলি কী করছে?

বিভিন্ন কলেজের তরফে জানানো হয়েছে, ফর্ম দেওয়ার ন্যূনতম নম্বর বিগত বছরগুলির মতোই ৬০-৭০% থাকছে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এক অভিজ্ঞ শিক্ষক বলেন, ‘‘ন্যূনতম ৬০% নম্বর পেলেই আমাদের কলেজে ভর্তির ফর্ম তোলা যাবে। মেধা-তালিকা তৈরির সময় মোট নম্বরের পাশাপাশি যে-বিষয়ে অনার্স পড়ার আবেদন জানানো হয়েছে বা তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য বিষয়ের নম্বরও বিবেচনা করা হবে। সবই বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কলেজের ওয়েবসাইটে।’’

নিছক মোট নম্বরে নয়, বিষয়ভিত্তিক নম্বরেও দুর্দান্ত ফল করেছেন এ বারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা। বাংলাতেও ১০০-য় ১০০ নম্বর পেয়েছেন অনেকে। তাই মেধা-তালিকা যে-ভাবেই তৈরি হোক, ৭৫-৮০ শতাংশ বা তারও বেশি পাওয়া অনেক ছাত্রছাত্রীই যে পছন্দের প্রতিষ্ঠানে পছন্দের বিষয়ে ভর্তির সুয়োগ পাবেন না, তা মোটামুটি নিশ্চিত। প্রেসিডেন্সি, যাদবপুরে অনেক বিষয়েই প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি নেওয়া হয়। তাই সেখানে আর এক বার নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ পাবেন পড়ুয়ারা। কিন্তু যেখানে প্রবেশিকার তেমন চল নেই, সেখানে কী হবে?

লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে শুধু ইংরেজি ও অর্থনীতিতে প্রবেশিকা পরীক্ষা হয়। মাইক্রোবায়োলজি ও বাংলায় ছাত্র ভর্তি হয় ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে। ওই কলেজের অধ্যক্ষা শিউলি সরকার বলেন, ‘‘বুঝতেই পারছি, স্নাতকে ভর্তির জন্য অনেক বেশি আবেদনপত্র জমা পড়বে। তার মধ্যে সেরা ছাত্রীদের বেছে নিতে প্রবেশিকা পরীক্ষা, ইন্টারভিউ, মেধা-তালিকা তৈরির গোটা প্রক্রিয়াটাই চালাতে হবে আরও কঠিন ভাবে। প্রতিযোগিতা অনেকটা বেড়ে গেল।’’

এ বার পরীক্ষা হয়েছে নতুন পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে। তার উপরে বিজ্ঞানের মতো কলা, বাণিজ্যেও প্রজেক্ট বা প্রকল্পের কাজ রাখা হয়। এ ছাড়া ১-২ নম্বরের ছোট প্রশ্নের সংখ্যা বাড়ানোয় নম্বর তোলা ও পাশ করা অনেক সহজ হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকে। উচ্চ মাধ্যমিকে এ বারের সর্বোচ্চ নম্বর ৯৯.২%। আইএসসি-তে সর্বোচ্চ নম্বর ৯৯.৭৫%। সিবিএসই-র দ্বাদশে ৯৯.২%।

ভর্তি-সমস্যা ছাড়াও প্রশ্ন উঠছে মান নিয়ে। দ্বাদশ শ্রেণিতে মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন (এমসিকিউ) বা সংক্ষিপ্ত উত্তর দেওয়ার মতো প্রশ্ন আইএসসি, সিবিএসই-তে কমই থাকে। সেই জায়গায় উচ্চ মাধ্যমিকে ওই ধরনের প্রশ্ন বাড়িয়ে নম্বর তোলা সহজ করা হলেও তাতে পঠনপাঠনের মান লঘু করা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রীরা মূলত যে-সব কারণে (স্কুলগুলির পরিকাঠামো, পড়ুয়াদের ব়ড় অংশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ইত্যাদি) পিছিয়ে পড়তেন, সেগুলো কমবেশি থেকেই গিয়েছে। তাই পাশের হার, প্রাপ্ত নম্বর ঢালাও ভাবে বাড়লেও তাতে আখেরে রাজ্যের শিক্ষা-মানচিত্রের কতটা অগ্রগতি হবে, পাশ করা পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎই বা কী, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

HS Students school teacher pass result
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE