Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

স্টেশন থেকে বেরিয়ে গুলির মুখে

সব দেখে হতভম্ব পম্পা, রাকেশরা। বছর কুড়ি-বাইশের বারোজন ছেলেমেয়ে বারাসত থেকে বুধবার সকালে পৌঁছেছিল বসিরহাটে। দণ্ডিরহাট নগেন্দ্রনাথ হাইস্কুলে রবীন্দ্রমুক্ত হাইস্কুলের মাধ্যমিকের সিট পড়েছে তাদের। এ দিন ছিল ফিজিক্যাল সায়েন্স পরীক্ষা।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সীমান্ত মৈত্র ও নির্মল বসু
বনগাঁ ও বসিরহাট শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৭ ০৪:০৫
Share: Save:

স্টেশনের বাইরে পা ফেলতেই দিশেহারা অবস্থা পম্পা, শঙ্কর, রাকেশ মহম্মদদের।

বাইরে তখন রিভলভার হাতে ছুটছে একদল লোক। গুলি ছুড়ছে। দুমদাম বোমা পড়ছে। একদল যুবক এসে কয়েকটা টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। দূরে তখন পরপর কিছু দোকানে লাঠিসোঁটা নিয়ে দমাদ্দম মারছে দুষ্কৃতীরা। এক জন জ্যারিকেন থেকে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানোর তোড়জোড় চালাচ্ছে।

সব দেখে হতভম্ব পম্পা, রাকেশরা। বছর কুড়ি-বাইশের বারোজন ছেলেমেয়ে বারাসত থেকে বুধবার সকালে পৌঁছেছিল বসিরহাটে। দণ্ডিরহাট নগেন্দ্রনাথ হাইস্কুলে রবীন্দ্রমুক্ত হাইস্কুলের মাধ্যমিকের সিট পড়েছে তাদের। এ দিন ছিল ফিজিক্যাল সায়েন্স পরীক্ষা।

আতঙ্কে ছোটাছুটি করছিল ছেলেমেয়েরা। পরে মনে হয়, থানায় গেলে কেমন হয়। সেই মতো, চলে আসে বসিরহাট থানায়। সেখান থেকে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী দিয়ে সকলকে পাঠানোর চেষ্টা হয়েছিল স্কুলে। কিন্তু মাঝপথে জানা যায়, পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। ভ্যাবলা স্টেশন থেকে ফিরবেন ভেবেছিলেন তাঁরা। সেখানে গিয়ে দেখেন, ভাঙচুর চালাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। বসিরহাটের পুরসভার গেস্টহাউসে সকলের রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন পুরপ্রধান তপন সরকার। তিনি বলেন, ‘‘এত গোলমালের মধ্যে ছেলেমেয়েদের ছাড়তে সাহস পেলাম না।’’

আরও পড়ুন: ঘরছাড়া অন্তঃসত্ত্বাদের আশ্রয় এখন কওসর-অসীমরাই

পম্পা মাইতি, শঙ্কর মণ্ডল, ঈপ্সিতা সেন, রাকেশ মহম্মদদের কথায়, ‘‘ট্রেনেই শুনছিলাম, চার দিকে গোলমাল ছড়িয়েছে। কিন্তু চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে আমরা সত্যি ঘাবড়ে যাই। যে কোনও মুহূর্তে গায়ে বোমা এসে পড়বে মনে হচ্ছিল।’’

ঘাবড়ে গিয়েছিলেন বনগাঁর কুমুদিনী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শম্পা বক্সিও। দত্তপুকুরে আটকেছিল তাঁর ট্রেন। শম্পাদেবী বলেন, ‘‘ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম, টায়ার জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ট্রেন থেকে নামতে সাহস পাইনি। কয়েক ঘণ্টা বসেছিলাম ট্রেনে। পরে যশোর রোড পর্যন্ত হেঁটে এসে সেখান থেকে অটো ধরে ফিরেছি।’’

বুধবার দফায় দফায় রেল ও সড়ক অবরোধের জেরে দুর্ভোগে বনগাঁ, বসিরহাট, বারাসতের মানুষ। বাইরে থেকে যাঁরা আসতে চেয়েছেন, তাঁরাও পৌঁছতে পারেননি। কেউ পরীক্ষা দিতে যেতে পারেননি। কারও কলকাতায় চিকিৎসকের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করতে হয়েছে। বসিরহাটে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত সবই বন্ধ ছিল। বনগাঁ মহকুমার স্কুল, সরকারি অফিসে হাজিরা ছিল কম। অনেক স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি দেওয়া হয়। বারাসতেও বহু স্কুল বন্ধ ছিল।

বুধবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বেলা ২টো পর্যন্ত বনগাঁ-শিয়ালদহ শাখায় রেল অবরোধের জেরে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। অশোকনগর, গুমা ও দত্তপুকুরে রেল অবরোধ হয়। অশোকনগরে যশোর রোডও অবরোধ হয়েছে। সড়ক অবরোধ হয়েছে হাবরা বামিহাটি এলাকায়। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র জানান, অবরোধের জেরে ১৯টি ট্রেন বাতিল করা হয়েছে।

বারাসত জেলা হাসপাতালে প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন বহু রোগী। এ দিন সেখানে উপস্থিতির হার ছিল ২০ শতাংশেরও কম। অনুপস্থিত ছিলেন বহু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। বারাসত পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরের পরীক্ষা ছিল এ দিন। হেঁটে পৌঁছন অনেক পরীক্ষার্থী ও শিক্ষাকর্মী। তবে পরীক্ষা দিতে আসতে পারেননি অনেকে। উপাচার্য জানান, যাঁরা পরীক্ষা দিতে পারেননি, তাঁদের জন্য বিকল্প ভাবা হচ্ছে।

বাংলাদেশি যাত্রীরাও নাকাল হয়েছেন নানা ভাবে। পেট্রাপোল সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন জামির আহমেদ। বনগাঁ স্টেশনে বসে বললেন, ‘‘দুপুরের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছনোর কথা ছিল। তা পারব না। জানি না, চিকিৎসককে আদৌ দেখাতে যেতে পারব কিনা।’’

অঞ্জলি মাকাল চার বছরের ছেলে সঞ্জীবকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন মাটিয়ায় বোনের বাড়িতে। পনেরো দিনের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে বুধবারই।

বসিরহাট থানায় বসে কাঁদছিলেন অঞ্জলি। ভয় পাচ্ছেন, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় পুলিশ না ধরে। তবে তাঁকে অভয় দিয়েছেন পুলিশ কর্তারা। জানিয়েছেন, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে ফেরার পথে যাতে তাঁর সমস্যা না হয়, তা দেখা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE