Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

মণ্ডল বনাম মণ্ডল লড়াই বচনে-বারুদে

মণ্ডল বনাম মণ্ডল। বীরভূমের রাজনৈতিক জমি এখন কার্যত দুই ‘মোড়লের’ কুস্তিখানা! এক জন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল (কেষ্ট)। নানুরের পটভূমিতে ‘গুড়-জলের’ রাজনীতিতে যিনি সিদ্ধহস্ত। অন্য জন, বিজেপি-র জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল। বাম রাজত্বেও ময়ূরেশ্বর অঞ্চলে বিজেপি-র ঝান্ডা অটুট রাখার পর যাঁর কাঁধে এখন জেলা ‘দখলের’ ভার। গত পাঁচ বছরে কেষ্ট মণ্ডলকে কখনও চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখায়নি তাঁর কোনও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।

অনুব্রত মণ্ডল ও দুধকুমার মণ্ডল

অনুব্রত মণ্ডল ও দুধকুমার মণ্ডল

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২৮
Share: Save:

মণ্ডল বনাম মণ্ডল।

বীরভূমের রাজনৈতিক জমি এখন কার্যত দুই ‘মোড়লের’ কুস্তিখানা!

এক জন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল (কেষ্ট)। নানুরের পটভূমিতে ‘গুড়-জলের’ রাজনীতিতে যিনি সিদ্ধহস্ত।

অন্য জন, বিজেপি-র জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল। বাম রাজত্বেও ময়ূরেশ্বর অঞ্চলে বিজেপি-র ঝান্ডা অটুট রাখার পর যাঁর কাঁধে এখন জেলা ‘দখলের’ ভার। গত পাঁচ বছরে কেষ্ট মণ্ডলকে কখনও চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখায়নি তাঁর কোনও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। সেই অপ্রতিরোধ্য কেষ্ট-বাহিনীর সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে দুধকুমারই এখন বীরভূম-রাজনীতির নতুন মুখ। ‘দিদি’র মণ্ডলের পাল্টা এই ‘মোদী’র মণ্ডল। যাঁর নাম এখন শুধু বীরভূম জেলা নয়, রাজ্য রাজনীতিতেও প্রাসঙ্গিক।

কে এই দুধকুমার?

বীরভূমের এক বিজেপি নেতার কথায়, “দু’বার সিপিএম এবং একবার পুলিশের প্রাণঘাতী হামলার পরেও বেঁচে ফেরা যে নেতা কেষ্ট মণ্ডলকে টক্কর দিচ্ছেন, তিনিই দুধকুমার। সিপিএম যখন দু’বারের চেষ্টাতেও মারতে পারেনি, তখন কেষ্ট মণ্ডলের হিম্মত নেই তাঁকে আটকায়!”

দুধকুমারের উপর পুরনো হামলার ঘটনাগুলি অবশ্য বিজেপির অন্দরে এখন নিয়মিত চর্চার বিষয়। জেলা নেতারা জানিয়েছেন, ১৯৯২ সালে ডিসেম্বর মাসে, অযোধ্যায় রামমন্দিরে করসেবা করতে গিয়েছিলেন তিনি। ফেরার পথে বর্ধমান স্টেশনে সিপিএমের লোকজন তাঁকে নামিয়ে নিয়েছিল। স্টেশনের বাইরে সিটু অফিসে নিয়ে গিয়ে ব্যাপক মারধর করা হয়। মারের চোটে অচৈতন্য হয়ে পড়লে হামলাকারীরা তাঁকে ফেলে পালায়। কয়েক ঘন্টা সে ভাবেই পড়ে থাকার পর স্থানীয় আরএসএসের কিছু কর্মী তাঁকে উদ্ধার করেন। ‘করসেবা’ করার অপরাধে দু’হাত ভেঙে দিয়েছিল হামলাকারীরা। সেই হামলার পিছনে ছিলেন বর্ধমান সিপিএমের এক দাপুটে নেতা। পরবর্তী কালে যিনি বর্ধমান পুরসভার মাথায় বসেছিলেন। ঘনিষ্ঠমহলে এখনও দুধকুমার সেই নেতার নাম করে নাকি বলেন,“যদি দেখা হয়, বোঝাব ভাঙা হাতের জোর কত!”

এর পরে ১৯৯৩-এর ১৩ জানুয়ারি পুলিশি হামলার মুখে পড়েন তিনি। দুধকুমারের নিজের বণর্নায়“রামপুরহাটের পাঁচ মাথার মোড়ে সে দিন পার্টির পিকেটিং চলছিল। বেশ বড় জমায়েত। হঠাৎ পুলিশ চড়াও হয়। তৎকালীন জেলাশাসক বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেখানে হাজির হন। তারপর প্রকাশ্যে তৎকালীন পুলিশ সুপার আরজেএস নালোয়া আমায় বেধড়ক পেটান।” দুধকুমারের অভিযোগ, হুমকিও দিয়ে ছিলেন পুলিশ সুপার, ‘তেরা জান লে লুঙ্গা।’

ঘটনাচক্রে সেই পুলিশ কর্তা এখন ‘হোমগার্ড কেলেঙ্কারি’তে জড়িয়ে পড়েছেন। দুধকুমার বলছেন, “কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ওই পুলিশ কর্তা তো এখন ঘোর সমস্যায়!”

--কিন্তু বাসুদেববাবু তো স্বরাষ্ট্র সচিব হয়েছেন? দুধকুমারের পাল্টা প্রশ্ন, “মমতার অধীনে স্বরাষ্ট্র সচিব হওয়া কি খুব সম্মানজনক?”

তবে মার খেতে খেতে বিজেপি নেতার উত্থান পর্ব নিয়ে গর্বের শেষ নেই কর্মীদের। তাঁদের অনেকেই জানিয়েছেন, সিপিএম তাঁর বিরুদ্ধে ১০টি দাঙ্গা-হাঙ্গামার মামলা করেছিল। যার তিনটির বিচারপর্ব এখনও শেষ হয়নি। ২০০৮ সালে ২১ মার্চ রাতে ময়ূরেশ্বর থেকে কোটাসুরে ফিরছিলেন তিনি। কালিকাপুরের কাছে তাঁর মোটরবাইক আটকে হামলা চালায় সিপিএম। মাটিয়ে লুটিয়ে যেতেই হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। সে যাত্রাতেও কোনওরকমে প্রাণে বাঁচেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে জেলা বিজেপি-র সভাপতি তিনি। এই ক’বছরে বীরভূমে বিজেপি যে অনেকটাই এগিয়েছে, সন্দেহ নেই। গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে বীরভূমের সবকটি পুরসভায় এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। বেশ কয়েকটি বিধানসভাতেও সেই ধারা অব্যাহত। আর তাতে আরএসএসের এই প্রাক্তন প্রচারকের অবদান যে যথেষ্ট তা মানছেন দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা।

দুধকুমারের বাড়ি বীরভূমের ময়ূরেশ্বরে। সেখানে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ(আরএসএস)-এর যুক্ত হন তিনি। আরএসএসের এক নেতার কথায়, “কিশোর বয়স থেকেই ভাল সংগঠকের সমস্ত গুণ দুধকুমারের ছিল। তাই তাঁকে সঙ্ঘ প্রচারক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল।”

সঙ্ঘ সূত্রের খবর, পড়াশোনা শেষ হলে, ১৯৮৪ সালে দুধকুমারকে আরএসএসের প্রচারক (সর্বক্ষণের সংগঠক) হিসাবে কাটোয়া মহকুমার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রচারক হিসাবে কাজ করেন। রামমন্দির আন্দোলনের মুখে বীরভূমে বিজেপির কাজে যোগ দেন দুধকুমার। সেই থেকে ময়ূরেশ্বরে বিজেপি-কে, কার্যত একাই দাঁড় করানোর কৃতিত্ব যে তাঁরই, মানছেন জেলার রাজনৈতিক মহল। ময়ূরেশ্বরের ভোটের ফলাফলেও সেই সত্যতার প্রমাণ মিলেছে। দুধকুমার বিজেপি-র কাজ শুরু করেন ১৯৯১ সালে। ১৯৯৩ সালে ময়ূরেশ্বরের পঞ্চায়েত দখল করে তারা। আশপাশের পঞ্চায়েতগুলিতেও প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়েছিল বিজেপি। ১৯৯৮ সালেও সেই সব পঞ্চায়েতের দখল ধরে রেখেছিল বিজেপি। সে বার দুধকুমার পঞ্চায়েত সমিতিতে জিতে তাক লাগিয়ে দেন। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনেও প্রার্থী হন তিনি।

তবে এ সব তথ্যে আমল দিচ্ছেন না দিদি-অনুগত কেষ্ট। তাঁর সাধের গোঁফে হাত বুলিয়ে মাছি তাড়াচ্ছেন অনুব্রত, “নতুন ডানা গজিয়েছে তো, একটু বেশি ঝাপটাচ্ছে। ক’দিন যেতে দিন, ঠিক হয়ে যাবে।”

বাহারি গোঁফের মালিক দুধকুমারও। মাঝে মাঝে সরু কাঁচি দিয়ে যার লালন করেন। সেই ঝুঁপো গোঁফে তর্জনির শাসন চালিয়ে বলছেন, “আমার ডানা কিন্তু মজবুত। আসলে কী জানেন, যাঁদের মাথায় অক্সিজেন পৌঁছয় না, তাঁদের বচনে বিষ তো থাকবেই।”

তবে বচনে নয়। বীরভূমের মণ্ডল বনাম মণ্ডল, পরস্পরকে টক্কর দিচ্ছে বোমা-বারুদ আর বাহুবলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE