Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা

দলেরই সদস্যাকে গণধর্ষণের চেষ্টা

যে সময় এলাকায় সিপিএম ছাড়া কারও দেখা মিলত না, তখন তৃণমূলের হয়ে পঞ্চায়েতে বুক চিতিয়ে লড়ে জিতেছিলেন তিনি। পালাবদলের রাজ্যে তৃণমূলের সেই পঞ্চায়েত সদস্যাই এ বার গণধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ আনলেন দলের এক নেতার বিরুদ্ধে। তিনি থানায় লিখিত অভিযোগ জানালেও পুলিশ এফআইআর করেনি। ঘটনাস্থল, পরিবর্তনের আঁতুড়ঘর নন্দীগ্রাম লাগোয়া খেজুরি।

তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যার বাড়ি। ছবি: সোহম গুহ

তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যার বাড়ি। ছবি: সোহম গুহ

সুব্রত গুহ
খেজুরি শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১৯
Share: Save:

যে সময় এলাকায় সিপিএম ছাড়া কারও দেখা মিলত না, তখন তৃণমূলের হয়ে পঞ্চায়েতে বুক চিতিয়ে লড়ে জিতেছিলেন তিনি। পালাবদলের রাজ্যে তৃণমূলের সেই পঞ্চায়েত সদস্যাই এ বার গণধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ আনলেন দলের এক নেতার বিরুদ্ধে। তিনি থানায় লিখিত অভিযোগ জানালেও পুলিশ এফআইআর করেনি। ঘটনাস্থল, পরিবর্তনের আঁতুড়ঘর নন্দীগ্রাম লাগোয়া খেজুরি।

দু’দিন আগে, পাশের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরের সদর শহরে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে এক বিধবার তরুণী মেয়েকে ধর্ষণ-খুনের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে মেদিনীপুরের তৃণমূল উপ-পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে। আর এ বার খেজুরিতে দলেরই পঞ্চায়েত সদস্যাকে গণধর্ষণের চেষ্টায় অভিযুক্ত তৃণমূলের স্থানীয় টিকাশি অঞ্চল সভাপতি স্বপন দাস-সহ আট জন।

মেদিনীপুরের মতো খেজুরির ঘটনাতেও উঠেছে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ। গত ২৪ অগস্ট স্বপন ও তাঁর দলবল বাড়িতে চড়াও হয়ে স্বামী ও ছেলের সামনেই পঞ্চায়েত সদস্যাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ। বিবস্ত্র করে তাঁকে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ। মঙ্গলবার হেঁড়িয়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রে ওই মহিলা লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। এর আগে গত ২৩ অগস্ট তিনি আর একটি অভিযোগে জানিয়েছিলেন, মাইকে প্রচার করে তাঁকে সামাজিক বয়কটের হুমকি দেওয়া হয়েছে। সেই অভিযোগে স্বপনের নাম না থাকলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ ৫ জনের নাম ছিল। দু’টি অভিযোগের প্রেক্ষিতেই পুলিশ জেনারেল ডায়েরি করেছে।

কেন করা হল না এফআইআর? হেঁড়িয়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা ভূপতিনগরের সার্কেল ইনস্পেক্টর সুবীর চৌধুরীর জবাব, “ওই এলাকায় চাষাবাদ সংক্রান্ত একটা গোলমালের কথা শুনেছিলাম। তবে সামাজিক বয়কট বা গণধর্ষণের কোনও অভিযোগের কথা জানা নেই।” ওই মহিলার কাছে অবশ্য হেঁড়িয়া তদন্ত কেন্দ্রে জমা দেওয়া দু’টি অভিযোগপত্রেরই প্রতিলিপি রয়েছে।

এর আগে নদিয়ার চৌমুহায় বিরোধীদের উদ্দেশে তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল হুমকি দিয়েছিলেন, ‘ছেলেদের ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব।’ তার পর খেজুরিরই লাগোয়া সুনিয়ায় ঘরছাড়া এক সিপিএম নেতার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় ও তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে খেজুরির এই গ্রাম পঞ্চায়েতে কে তৃণমূলের মহিলা প্রধান হবেন, তা নিয়ে দলে কোন্দল চলছিল। সেই সময় থেকেই অভিযোগকারিণীর সঙ্গে তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি স্বপনের বিরোধ শুরু। তার জেরে সম্প্রতি ওই মহিলাকে তাঁর পারিবারিক জমিতে চাষের কাজে বাধা দেওয়া হয়। তখনও তিনি পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। কিন্তু সুরাহা হয়নি। মহিলার অভিযোগ, “পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে স্বপন ও তাঁর সঙ্গীদের দাপট বাড়তে থাকে। গ্রামবাসীকে ওরা বলে দেয়, আমাদের সঙ্গে না মিশতে।”

গত ২১ অগস্ট আরও এক ধাপ এগিয়ে স্বপনরা গ্রামে একেবারে মাইকে প্রচার করেন যাতে ওই মহিলার পরিবারকে সামাজিক ভাবে বয়কট করা হয়। মহিলার কথায়, “সে দিন ওরা বলেছিল, আমাদের বাড়িতে ধোপা, নাপিত, পুরোহিত কেউ ঢুকতে পারবে না। এমনকী কেউ পরিচারিকার কাজও করতে পারবে না।” ঘটনায় ২৩ অগস্ট অভিযোগ দায়ের করার পরই স্বপন খেপে যান এবং তার জেরেই ২৪ অগস্ট রাত এগারোটা নাগাদ মহিলার বাড়িতে দলবল নিয়ে চড়াও হয়ে গণধর্ষণের চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ।

খেজুরি-১ ব্লকের ওই গ্রামে মঙ্গলবার গিয়ে বাড়িতেই পাওয়া গেল পঞ্চায়েত সদস্যাকে। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন বছর পঁয়তাল্লিশের ওই মহিলা। বললেন, “আমার স্বামী ও ছেলে বাঁচাতে এলে ওদেরকেও মারধর করা হয়। আমি হাতেপায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছিলাম। ওরা বলল, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা না দিলে খুন করে দেবে।”

অনেকটা একই বিবরণ পাওয়া গেল প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানালেন, ২৪ অগস্ট রাতে স্বপন ও তাঁর অনুগামীরা তৃণমূলের ওই পঞ্চায়েত সদস্যাকে চুলের মুঠি ধরে বাইরে টেনে এনে মারছিলেন। তখন তাঁরা খুন-ধর্ষণের হুমকিও দিচ্ছিলেন। ওই মহিলাকে একঘরে করে রাখার বিষয়টিও স্বীকার করেছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ। দলের বুথ সভাপতি নবকুমার বেরা, বুথ সম্পাদক নাড়ু গিরি, যুব তৃণমূলের টিকাশি অঞ্চল সভাপতি সমীরণ দাস সমস্বরে বলছেন, “স্বপন দাস ও তাঁর অনুগামীদের অত্যাচারে ওই মহিলার জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে গিয়েছে।” মেদিনীপুরের উপ-পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে ধর্ষণ-খুনের হুমকির অভিযোগ ওঠার পর দলীয় স্তরে তদন্ত শুরু করেছে তৃণমূল। খেজুরি কাণ্ড নিয়ে অবশ্য দলের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা নেতারা ভিন্ন সুরে কথা বলছেন। তৃণমূলের জেলা সভাপতি শিশির অধিকারীর দাবি, “অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী পঞ্চায়েত সদস্যা আমাদের দলের হলেও বিষয়টি একেবারে ব্যক্তিগত কাজিয়া। পুলিশ যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে।” খেজুরির তৃণমূল বিধায়ক রণজিৎ মণ্ডল অবশ্য বলেন, “অভিযোগ শুনেছি। দু’পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসা হবে।”

খেজুরির ঘটনার প্রেক্ষিতে শাসক তৃণমূলকে বিঁধতে ছাড়ছে না বিরোধীরা। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “তৃণমূল যে তাপস পাল সংস্কৃতি গ্রহণ করে নিয়েছে, ফের তারই দৃষ্টান্ত এই ঘটনা। মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্য নেতাদের দলের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।” সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মতে, “ধর্ষণ বা ধর্ষণের হুমকিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যখন বিরোধী রাজনৈতিক দল বা অন্য কেউ এর শিকার হয়েছেন, তখন বারেবারেই ছোট্ট ঘটনা বলে মুখ্যমন্ত্রী সে সব আড়াল করেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেও একই দাওয়াই দেওয়ার চেষ্টা চলছে।”

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই মহিলার গ্রামে আগে দুটি পঞ্চায়েত আসন ছিল। ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তার একটিতে জিতেছিলেন ওই মহিলা। ২০০৩ ও ২০০৮ সালে খেজুরি যখন লাল-দুর্গ, তখনও ওই মহিলা তৃণমূলের টিকিটে ভোটে লড়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। তবে জিততে পারেননি। তত দিনে ওই গ্রামের দু’টি পঞ্চায়েত আসন কমে একটি হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটের পর কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দেন স্বপন দাস। গোড়া থেকেই তৃণমূলে প্রবীণ ওই মহিলার সঙ্গে স্বপনের বিরোধ বাধে।

২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে ফের ওই গ্রামের পঞ্চায়েত আসন বেড়ে দু’টি হয়। ৭১ নম্বর বুথের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও দলের নির্দেশে ওই মহিলা ৭০ নম্বর বুথ থেকে দাঁড়িয়ে ভোটে জেতেন। মহিলা সংরক্ষিত পঞ্চায়েত প্রধান পদটির জন্য দল তাঁরই নাম প্রস্তাব করে। কিন্তু এলাকার দাপুটে নেতা স্বপন ও তাঁর অনুগামীরা দলীয় নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ছন্দা দাস নামে এক পঞ্চায়েত সদস্যার নাম প্রধান পদের জন্য প্রস্তাব করেন। ভোটাভুটিতে জিতে ছন্দাদেবীই প্রধান হন। আর এর পর থেকেই স্বপনের সঙ্গে বিরোধ বাড়তে থাকেওই মহিলার।

যাঁর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই স্বপনকে এ দিন এলাকায় পাওয়া যায়নি। তবে ফোনে যোগাযোগ করা হলে সব অভিযোগই তিনি অস্বীকার করছেন। তাঁর বক্তব্য, “গণধর্ষণের অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমরা কেউ ২৪ তারিখ ওই মহিলার বাড়িতে যাইনি।” আর সামাজিক বয়কটের হুমকি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “ওই মহিলার বিরুদ্ধে এলাকার মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। তার জেরে কিছু সমস্যা হতে পারে। তবে কাউকে সামাজিক বয়কট করা হয়নি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

subrata guha tmc party cadre gangrape
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE