Advertisement
E-Paper

বধূর ওড়না টেনে পুলিশকে মার তৃণমূল নেতার

রাতের অন্ধকারে বাঁকুড়া শহরের বাসস্ট্যান্ডে এক দল দুষ্কৃতীর হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন দুর্গাপুর শহরের এক বধূ। পুলিশকে যোগাযোগ করতে পারেননি। এলাকার এক জনের কাছ থেকে স্থানীয় যুব তৃণমূল নেতার ফোন নম্বর পেয়ে তাঁকেই সাহায্যের জন্য ডেকেছিলেন ওই বধূ। সেই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধেই ওই বধূকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠল। স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে মার খেলেন স্বামী। ওই দম্পতিকে উদ্ধার করতে গিয়ে তৃণমূল নেতার রোষের মুখে পড়ল পুলিশও।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৫ ০৩:৪৫
ধৃত বাপি চক্রবর্তী। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

ধৃত বাপি চক্রবর্তী। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

রাতের অন্ধকারে বাঁকুড়া শহরের বাসস্ট্যান্ডে এক দল দুষ্কৃতীর হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন দুর্গাপুর শহরের এক বধূ। পুলিশকে যোগাযোগ করতে পারেননি। এলাকার এক জনের কাছ থেকে স্থানীয় যুব তৃণমূল নেতার ফোন নম্বর পেয়ে তাঁকেই সাহায্যের জন্য ডেকেছিলেন ওই বধূ। সেই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধেই ওই বধূকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠল। স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে মার খেলেন স্বামী। ওই দম্পতিকে উদ্ধার করতে গিয়ে তৃণমূল নেতার রোষের মুখে পড়ল পুলিশও। মার খেলেন এক এএসআই।

সোমবার রাতের ওই ঘটনায় রাজ্য জুড়ে নিন্দা-সমালোচনার ঝড় উঠলেও অভিযুক্ত পীযূষ ওরফে বাপি চক্রবর্তীকে ‘সৎ ছেলে’ ও ‘সমাজকর্মী’ হিসাবে প্রশংসা করছেন বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষ নেতা তথা জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী! উল্টে নিগৃহীতার চরিত্রের দিকেই ইঙ্গিত করে তিনি রাতে বাসস্ট্যান্ডে কী করছিলেন, তা পুলিশ খতিয়ে দেখুক বলেও মত দিয়েছেন!

যা শুনে বিরোধীদের বক্তব্য, দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথেই হেঁটেছেন বাঁকুড়ার সভাধিপতি। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রায়গঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ তৃণমূল নেতাদের হাতে মার খাওয়ার পরে মমতা বলেছিলেন, ছোট্ট ঘটনা। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডে বলেছিলেন, সাজানো ঘটনা। কাটোয়ার ছোট রেলে এক মহিলার মেয়ের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে যখন তাঁকে ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠল দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে, তখন মুখ্যমন্ত্রী বলে বসেন, ‘ওই মহিলার স্বামী সিপিএম করেন’। অথচ নির্যাতিতা ছিলেন বিধবা। একই ভাবে সালকিয়ায় ইভ-টিজিংয়ের প্রতিবাদ করে নিহত অরূপ ভাণ্ডারীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দু’টো গ্রুপের গোলমাল’! সম্প্রতি টালিগঞ্জে কলকাতার মেয়রের ভাইঝির বিরুদ্ধে কর্তব্যরত ট্র্যাফিক কনস্টেবলকে হেনস্থার অভিযোগে বিধানসভায় মমতা বলেন, ‘‘বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে একটা ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ তার জন্য লাইসেন্স কেড়ে নেবে?’’

বিরোধীরা বলছেন, তৃণমূলের শাসনে এটাই দস্তুর। রাজ্যে দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াবে। আর পারও পেয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বাপিকে গ্রেফতার করা হলেও পরবর্তীতে কোনও না কোনও ভাবে পুলিশ মামলা ধামাচাপা দিয়ে দেবে বলেও আশঙ্কা বিরোধীদের। সোমবার বাপিকে আদালতে তুলে পুলিশ নিজেদের হেফাজতে না চাওয়ায় ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। আদালত ধৃতকে ১৪ দিন জেল হাজতে পাঠিয়েছে। জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, ‘‘বাপির কােছ যা জানার, জানা হয়ে গিয়েছে। আর হেফাজতে রাখার প্রয়োজন ছিল না।’’

কী হয়েছিল সোমবার রাতে?

দুর্গাপুর শহরের বেনাচিতির বাসিন্দা ওই বধূ একটি আয়ুর্বেদিক প্রসাধনী সংস্থায় কাজ করেন। সেই সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। সোমবার ওই কাজেই অফিসের কিছু কর্মীর সঙ্গে পুরুলিয়ার হুড়া ব্লকের বিষপুরিয়ায় যাচ্ছিলেন। সঙ্গে স্বামীও ছিলেন। বধূর অভিযোগ, রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ বাস বাঁকুড়া শহরের গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ডে বাস থেকে নামতেই মোটরবাইক আরোহী একদল যুবক তাঁদের ঘিরে ধরে। পরে ওই যুবকদের দু’জন তাঁর ওড়না ধরে টানতে শুরু করে। ওই বধূর কথায়, ‘‘এলাকারই এক জন আমাদের পুলিশে ফোন করতে বলেন। ‘১০০ ডায়াল’-এ ফোন করি। লাইন ব্যস্ত ছিল। স্থানীয় থানার নম্বর চাইতে ওই যুবক একটি মোবাইল নম্বর দেন। ফোন করে জানতে পারলাম তা বাপি চক্রবর্তী নামে স্থানীয় তৃণমূল নেতার। বাধ্য হয়ে তাঁর কাছে সাহায্য চাই।’’

দম্পতির অভিযোগ, রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ বাপি এসে মোটরবাইকে আসা যুবকদের মারধর শুরু করেন। বাপি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। তার পরে বধূর সহকর্মীদেরও পেটান। এর পরে বাপি ওই বধূর ওড়না আর হাত ধরে টানাটানি শুরু করেন। বাঁচাতে গিয়ে মার খান স্বামী। ওই সময়ই পুলিশের ভ্যান চলে আসে। বাপির দল পুলিশকর্মীদেরও রেয়াত করেনি। ভ্যানে থাকা বাঁকুড়া সদর থানার এক এএসআইয়ের কলার ধরে তাঁকে চড়-কিল-লাথি-ঘুষি মারে। মারের চোটে ওই পুলিশ কর্মীর মোবাইল পড়ে যায়। বাপি সেই মোবাইল পায়ে চাপা দিয়ে ভেঙে ফেলেন। ওই বধূর কথায়, ‘‘এর পর বাপি বলল, মালকড়ি কী আছে, বের কর। আমি বলি, আমাদের কাছে কিছু নেই। বাপির নির্দেশে ওর লোকেরা আমাদের মোবাইল আর ভোটার কার্ড কেড়ে নিল।’’

ততক্ষণে নিগৃহীতার সহকর্মীরা পালিয়েছেন। বাপি-ই ওই দম্পতিকে ঠেলে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেন বলে বধূর স্বামী জানান। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘আমার চোখের সামনে আমার স্ত্রীর শ্লীলতাহানি করল বাপি। পুলিশকেও পেটাল। সিনেমায় অনেক বার দুষ্কৃতীদের হাতে পুলিশকে মার খেতে দেখেছি। কিন্তু, নিজের চোখে এই ঘটনা দেখে চমকে গিয়েছি। এত লোকের সামনে যে ভাবে ওই পুলিশকর্মীকে বাপি মারল, দেখে শিউরে গিয়েছিলাম। খুব অসহায় লাগছিল নিজেদের।’’ শেষ পর্যন্ত অবশ্য পুলিশ তাঁদের থানায় নিয়ে যায়। এর পরে বড় বাহিনী গিয়ে বাপিকে প্রথমে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়। সোমবার সকালে বাপির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন নিগৃহীতা। তার পরেই বাপিকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃতের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি, সরকারি কাজে বাধাদান-সহ একাধিক জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা হয়েছে।

এর আগেও নানা অভিযোগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন বাপি। সব অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়েছেন জেলা রাজনীতিতে বাপি যাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত, সেই সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘বাপি সৎ ছেলে। সমাজকর্মী। ওই মহিলা মাঝরাতে বাসস্ট্যান্ডে কী করছিলেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কিছু গুন্ডা বাসস্ট্যান্ডে মহিলার পিছু নিয়েছিল। তা শুনেই বাপি ঘটনাস্থলে যায়।’’ তাঁর আরও দাবি, বাপি পুলিশকে মারেননি। বচসা চলাকালীন ওই পুলিশকর্মীর হাত থেকে মোবাইল ফোন পড়ে ভেঙে যায়। তৃণমূলকে বদনাম করতে পুলিশের একাংশ বাপিকে ফাঁসাতে চাইছে।

বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, এ ভাবেই বারবার নারী নির্যাতন থেকে পুলিশকে মারধর— সব ঘটনায় নিজেদের দলের অভিযুক্তদের তদন্তের আগেভাগেই ‘ক্লিনচিট’ দিয়ে দিচ্ছেন শাসকদলের নেতারা। বাঁকুড়ার বাসিন্দা, বিজেপি-র রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার বলেন, ‘‘শাসক দলের হাতে মার খেয়ে খেয়ে পুলিশের মনোবল এমনিতেই তলানিতে ঠেকেছে। ওরা কী করে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেবে। ধৃতের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে পুলিশ প্রমাণ করুক, তাদেরও মেরুদণ্ড আছে!’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, প্রাক্তন বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্রের কটাক্ষ, ‘‘এই জমানায় পুলিশ এমনিতেই বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় বা চক্রবর্তীদের ধরতে ভয় পায়। কারও ভাইপো বা ভাইঝি হলে তো কথাই নেই!’’ সভাধিপতির বক্তব্য প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘পার্ক স্ট্রিটের ক্ষেত্রেও দেখেছি, নির্যাতিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা। এখানেও ওই বধূ রাতে বাসস্ট্যান্ডে কী করছিলেন বলে অরূপবাবু নিজের রুচিবোধেরই প্রমাণ রাখলেন।’’

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাঁকুড়ায় ঠিক কী ঘটেছে, সে ব্যাপারে জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলব। তার আগে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’’

trinamool tmc police bankura mamata bandopadhyay bapi chakroborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy