মুকুল এই কথা বললেও দল এবং বাংলার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অনেকেই কিন্তু অন্য কথা বলছেন। তৃণমূলের অন্দরে যে চর্চা চলছে, তার থেকে মুকুল-মন্তব্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে দু’টি ব্যাখ্যা উঠে আসছে। এক, বিপদ হতে পারে বুঝে তিনি নিজে বাঁচতে চেয়েছেন। বিতর্কিত চুক্তির প্রসঙ্গ থেকে হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছেন। আর দুই, সাংসদ কুণাল ঘোষের মতো তিনিও বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি একাই কেবল দোষের ভাগী হবেন না। কান টানলে মাথাও আসবে! বিরোধী সিপিএমের এক নেতার কথায়, “সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে জনসভায় দাঁড়িয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন, আমি চোর? মুকুল চোর? মদন চোর? কুণাল চোর? দেখা যাচ্ছে, যাঁদের নাম সে দিন নিয়েছিলেন, প্রত্যেকের দিকেই একে একে আঙুল উঠছে! এবং আরও দেখা যাচ্ছে, নাম ওঠার পরে প্রত্যেকেই দলে একা হয়ে যাচ্ছেন!”বিরোধী দলগুলির নেতারা বলছেন, সারদা-কাণ্ডের তদন্ত এগোতেই শাসক দলের নেতারা এখন যে যার মতো নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ যেমন এ দিনও বলেছেন, “বিপদ যখন মাথার কাছে চলে আসে, তখন সবাই নিজেকে বাঁচাতে চায়। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা!” শাসক দলে যে এক অর্থে মুষল-পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে, সে দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের অন্দরে যে ব্যাপক সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা মুকুলবাবুর কথা থেকেই স্পষ্ট।” একই ভাবে তৃণমূলের এক রাজ্য নেতারও বক্তব্য, “সারদা-কাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে আমাদের দলের সাংসদ কুণাল ঘোষ গ্রেফতার হওয়ার সময়ে বলেছিল, আমি ডুবলে সবাইকে নিয়েই ডুবব! এটা আবার সেই রকম কোনও পরিকল্পনা থেকে বলা হয়নি তো!”
শাসক দলেরই কিছু নেতা আবার এর সঙ্গে ভিন্নমত। সারদা-কাণ্ড নিয়ে সিবিআই তদন্তের বাঁধন যত শক্ত হচ্ছে, দলের অনেকেই তাতে প্রমাদ গুনছেন। সেই প্রেক্ষাপটে ওই নেতাদের বক্তব্য, মুকুলবাবুকে ভবিষ্যতে যাতে ‘বলির পাঁঠা’ না করা হয়, সে জন্য ভেবেচিন্তেই তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। ঘটনা হল, দলের মধ্যেই মুকুলের দাপটে যাঁরা ত্রস্ত, তাঁদের অনেকেই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যে অশুভ ইঙ্গিত খুঁজে পাচ্ছেন। দলের এক প্রবীণ মন্ত্রীর মতে, “রেল-সারদা চুক্তি নিয়ে যখন সংবাদমাধ্যম এবং বিরোধী দলগুলি আমাদের নেত্রীকে নিশানা করার অপচেষ্টা করছে, সেই সময় মুকুল এ ভাবে না বললেই পারতেন!” ওই মন্ত্রীর ব্যাখ্যা, সারদা পরে কী কী অনৈতিক কাজ করবে, ২০১০ সালে তো তা কেউ জানত না! একটা বাঙালি প্রতিষ্ঠান রেলে বরাতের জন্য আবেদন করেছে, তা মঞ্জুর হয়েছে। এ নিয়ে তৃণমূল দল বা দলনেত্রীর দিকে আঙুল তোলার চেষ্টা বাংলার মানুষ বরদাস্ত করবেন না! এই কথা বলেই অনায়াসে বিষয়টি সামাল দিতে পারতেন মুকুল। কিন্তু তিনি তা করেননি।
কেন করেননি, তারও ব্যাখ্যা উঠে এসেছে দলের অন্দরের আলোচনা থেকে। তৃণমূলের একাংশ বলছেন, এটা শুধু সারদায় নিজেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা নয়। তা-ই যদি হতো, তা হলে মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু হঠাৎ দলীয় মঞ্চ থেকে সিন্ডিকেট, গরু পাচার-সহ বিভিন্ন অনৈতিক ও বেআইনি কাজকর্ম নিয়ে মুখ খুলতেন না। দলনেত্রীর নেকনজরে পড়ে যাঁরা এখন সংগঠনে গুরুত্ব পাচ্ছেন, তাঁদেরই কারও কারও বিরুদ্ধে কৌশলে শুভ্রাংশু বার্তা দিচ্ছিলেন বলে তৃণমূলের একাংশের মত। এ বারে যেমন মুকুলবাবুর কথায় ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেত্রী, সে দিনও শুভ্রাংশুর বক্তৃতা শুনে রুষ্ট হয়েছিলেন তিনি।
এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দলের একাংশ বলছে, তৃণমূল নেত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের সম্পর্ক মোটেও মসৃণ নয়। দিল্লিতে অণ্ণা হজারেকে নিয়ে তৃণমূল নেত্রীর বিড়ম্বনার সময় থেকে সম্পর্ক আরও বন্ধুর হয়েছে। দলের অন্দরের সমীকরণের তাগিদেই বরং শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতাদের সঙ্গে অভিষেকের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। যার জেরে সংগঠনের উপরে প্রভাব শিথিল হয়ে পড়ার আশঙ্কায় ভুগছে মুকুল-শিবির। এই টানাপড়েন থেকেই সরব হতে শুরু করেছিলেন মুকুল-পুত্র। এ বার সেই চিত্রনাট্যই খোদ মুকুল নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন বলে দলের এই অংশের ব্যাখ্যা। এই অংশের নেতাদের মতে, দলনেত্রীকে চাপে রাখতে চেয়েই মুকুলের ওই মন্তব্য। এক নেতার কথায়, “দলনেত্রী যাতে মুকুলবাবুর উপরেই নির্ভরশীল থাকেন, সেই কারণে বুঝে-সুঝেই ওই মন্তব্য করেছেন। গোটা সংগঠনটা যেন নেত্রী মুকুলবাবুর চোখ দিয়ে দেখেন, সেই পরিস্থিতি তৈরি করতেই ওই ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে।”
যে কারণেই তিনি বলুন, মুকুল মুখ খোলার পরে বাড়ছে জল্পনা! স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সিবিআই যত এগোচ্ছে, তৃণমূলের অন্দরে একে অপরকে তত সন্দেহের চোখে দেখছেন!