Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ভিন্ রাজ্য পারলেও পারে না বাংলা, গুটখা বিক্রি অবাধেই

দৃশ্য ১: ধর্মতলায় রাস্তার ধারে দোকান। ১৪ বছরের কিশোর থেকে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ— ক্রেতা সকলেই। কেনার সঙ্গে সঙ্গে হাতে মিশে চালান হয়ে যাচ্ছে মুখের ভিতরে। দু’টি প্যাকেটের উপরেই লেখা পান মশালা। লোকে বুঝবেন কী ভাবে? দোকানদারের বক্তব্য, যাঁরা রোজকারের খদ্দের, তাঁরা সব জানেন।

প্রকাশ্যে গুটখা কেনাবেচা।

প্রকাশ্যে গুটখা কেনাবেচা।

অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০১:২২
Share: Save:

দৃশ্য ১: ধর্মতলায় রাস্তার ধারে দোকান। ১৪ বছরের কিশোর থেকে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ— ক্রেতা সকলেই। কেনার সঙ্গে সঙ্গে হাতে মিশে চালান হয়ে যাচ্ছে মুখের ভিতরে। দু’টি প্যাকেটের উপরেই লেখা পান মশালা। লোকে বুঝবেন কী ভাবে? দোকানদারের বক্তব্য, যাঁরা রোজকারের খদ্দের, তাঁরা সব জানেন।

দৃশ্য ২: আশুতোষ মুখার্জি রোডে একটি বেসরকারি স্কুলের গেট থেকে কিছু দূরেই পানের দোকান। সামনে সাজানো বিস্কুট, লজেন্স। কিন্তু কোনও ছাত্র গিয়ে নিচু গলায় কথা বললেই বেরিয়ে আসছে সুপারি আর জর্দার প্যাকেট। ছাত্র থেকে অফিসযাত্রী— সকলেই কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। চাইলে মিলছে সিগারেট-বিড়িও।

দৃশ্য ৩: সকাল ১১টা ৪০। বি টি রোডে কাশীপুর-চিড়িয়ামোড়ে সিগন্যালে এসে দাঁড়াল কয়েকটি গাড়ি। এক জন হকার হাতে বিভিন্ন পান মশালার প্যাকেট ঝুলিয়ে প্রত্যেক গাড়ির সামনে যাতায়াত শুরু করলেন। অনেক গাড়ি
থেকেই কাচ নামিয়ে তা কিনে নিলেন আরোহীরা।

অতিরিক্ত সিসা এবং মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (আজিনামোতো) থাকার কারণে সদ্য কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে দেশ জুড়ে বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে ম্যাগির। এর আগে ২০১৩ সালের ১ মে রীতিমতো সরকারি নির্দেশ জারি করে বিক্রি বন্ধ করা হয়েছিল গুটখার। তার পরে কেটে গিয়েছে দু’ বছর। ঘুরপথে গুটখা বিক্রিতে কিন্তু বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। শহরের বিভিন্ন মোড়ে পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানে অবাধে চলছে ভাজা সুপারি এবং জর্দা বিক্রি। আলাদা আলাদা দু’প্যাকেট কিনে হাতে মিশিয়ে তা চালান হয়ে যাচ্ছে মুখের ভিতরে।

শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ, ছবিটা সর্বত্র এক। গুটখা খেলে কী ক্ষতি হতে পারে, তা সকলে জানেনও। এতদ্সত্ত্বেও তার আকর্ষণ সাধারণ মানুষের কাছে কমছে না কিছুতেই। তা সে যতই প্যাকেটের উপরে ক্ষতিকর প্রভাব ছাপার অক্ষরে লেখা থাক বা সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমে গুটখার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞাপন দেখানো হোক। আইনের ফাঁক গলে অবাধে চলছে বিক্রি। ফলে শহরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মুখের ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা।

সামাজিক সচেতনতা না বাড়লে এই প্রবণতা রোখা যে কঠিন, তা পরিষ্কার হয়ে গেল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের কথায়। ওই বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্গীত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজর্ষি বসু বলেন, ‘‘গুটখা নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও সুপারি আর জর্দা আলাদা ভাবে বিক্রি হচ্ছে। আমার অনেক বন্ধু তা কিনে খাচ্ছেও।’’

কী ভাবে ক্ষতি করে এই গুটখা? এসএসকেএম হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, চিকিৎসক অর্ণব মজুমদার বলেন, ‘‘ক্রমাগত তামাক এবং চুনের মিশ্রণে মুখের মিউকাস মেমব্রেনের ক্ষতি হতে থাকে। তার পরে মুখের ভিতরের ছাল উঠে গিয়ে প্রাথমিক ভাবে ক্যানসারের সম্ভাবনা তৈরি হয়। পরে তা বড় আকার নিলে জীবনহানিও হতে পারে।’’

একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সোমনাথ সরকার বলেন, ‘‘দৈনন্দিন অভ্যাসের ফলে গুটখা জাতীয় তামাকদ্রব্য শুধু মুখ গহ্বরের নয়, দাঁত, জিভ, টাকরা, টনসিল, এমনকী স্বরযন্ত্রেরও ক্ষতি করে। বহু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।’’ সামাজিক সচেতনতা ছাড়া গুটখা বিক্রি রোখা যে কঠিন, তা মানছেন সকলেই। আর এক বেসরকারি হাসপাতালের ক্যানসার বিশেষ়জ্ঞ সৌরভ দত্ত বলেন, ‘‘আজ ম্যাগি বিক্রি বন্ধ করা নিয়ে আমরা মাতামাতি করছি, কিন্তু তার চেয়ে দশগুণ বেশি ক্ষতিকর গুটখা। এর বিক্রি বন্ধে কিন্তু রাজ্য সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। মহারাষ্ট্র, গোয়া অথবা মধ্যপ্রদেশের সরকার যদি এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ করতে পারে, তা হলে আমরা পারব না কেন?’’

ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE