একটা ভুল সামাল দিতে গিয়ে ফের ভুলের ফাঁদে!
ছাত্রী নিগ্রহের ঘটনার তদন্তে উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর গড়া কমিটির উপরে গোড়া থেকেই আপত্তি ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের। কিন্তু তাঁদের দাবি মেনে কমিটি বদলাতে রাজি হননি উপাচার্য। আর তার পরিণতিতেই উত্তাল হয়েছে ক্যাম্পাস। রবিবার উপাচার্যের প্রতি খানিকটা অনাস্থা দেখিয়েই সরকারের তরফে আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা ঘোষণা করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সোমবার সেই কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণার পরে দেখা গেল, রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় ও কেন্দ্রীয় আইনের পরিপন্থী।
পাঁচ সদস্যের সরকারি কমিটির মাথায় রয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। সদস্যরা হলেন, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য, বেথুন কলেজের অধ্যক্ষ সঙ্গীতা ত্রিপাঠি মিত্র এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সাংবাদিকতা ও জনসংযোগ বিভাগের প্রধান অনন্যা চক্রবর্তী। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলে এই কমিটি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দিতে পারবে বলেই তাঁরা আশা করছেন। একই কথা বলেছেন সুরঞ্জনবাবুও। তিনি জানিয়েছেন, কমিটি ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে।
কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহ প্রতিরোধে তৈরি বিশাখা নির্দেশিকা বলছে, যৌন নিগ্রহের তদন্তে গড়া কমিটির প্রধান হবেন এক জন মহিলা। এবং কমিটির অন্তত অর্ধেক সদস্যকে মহিলা হতে হবে। এই গাইডলাইন তৈরি হওয়ার পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০১৩-র এপ্রিলে কর্মস্থানে যৌন নিগ্রহ বন্ধে আইন তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সেখানেও কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে এই সব শর্তের কথা বলা আছে। আইনজীবীদের মতে, কর্মক্ষেত্র হোক বা না-হোক, যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্তে গড়া সব কমিটির ক্ষেত্রেই এই শর্ত প্রযোজ্য। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলেছেন, “রাজ্য সরকারের এই কমিটি বর্তমান আইনের পরিপন্থী। আগে বিশাখা গাইডলাইন ছিল। এখন কেন্দ্রীয় আইন (২০১৩ সালের কর্মস্থানে মহিলাদের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ, নিষিদ্ধকরণ আইন) হয়েছে। সেই আইন এই ধরনের সব কমিটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।”
রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়েরও বক্তব্য, শ্লীলতাহানি বা যৌন নির্যাতনের অভিযোগের তদন্তের জন্য প্রতিষ্ঠানের ভিতরে বা বাইরে যেখানেই কমিটি গড়া হোক না কেন, সেখানে বিশাখা গাইডলাইনই মানার কথা।
শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবু এবং কমিটির প্রধান সুরঞ্জনবাবু এ কথা মানতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, ওই আইন কোনও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাজ্যের কমিটির ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নয়। পার্থবাবুর কথায়, “এটি পৃথক সরকারি তদন্ত কমিটি। এর সঙ্গে বিশাখা গাইডলাইনের সম্পর্ক নেই। যে তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে, তাতে দু’জন মহিলা সদস্যও রয়েছেন।”
যদিও আইনজীবীদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, এই কমিটি নিয়ে কেউ আদালতের দ্বারস্থ হলে রাজ্য সরকারকে বিপাকে পড়তে হবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কমিটি (আইসিসি) নিয়ে সমস্যা হচ্ছে দেখে রাজ্য সরকার যখন শেষ পর্যন্ত পৃথক কমিটি গড়লই, তা হলে আরও ভেবেচিন্তে কেন পদক্ষেপ করা হল না, সেই প্রশ্ন উঠছে।
আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ প্রশমনের লক্ষ্যও এই কমিটি দিয়ে পূরণ করতে ব্যর্থ রাজ্য সরকার। যাদবপুরের পড়ুয়ারা জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য সরকারের উপরে তাঁদের কোনও আস্থা নেই। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিও তাঁরা ছাড়তে নারাজ। পড়ুয়াদের তরফে চিরঞ্জিৎ ঘোষের বক্তব্য, যে সরকার দাবি করেছে ছাত্রেরা অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের গড়া কমিটি পক্ষপাতদুষ্টই হবে। সেই সঙ্গেই কমিটির বিন্যাস নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেছেন, “আমরা ওই ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গড়তে বলেছিলাম। তাতে এক জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কিংবা পড়ুয়াদের প্রতিনিধি থাকা উচিত। কিন্তু এই নতুন কমিটিতে সে রকম কেউও নেই।” যাদবপুরের শিক্ষক সংগঠন জুটা-ও সরকারের গড়া এই তদন্ত কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ফলে উপাচার্যদের প্রতি আপাত অনাস্থা দেখিয়েও যাদবপুরের পড়ুয়াদের নরম করতে পারল না সরকার। উল্টে জড়াল নতুন বিতর্কে।
শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য উপাচার্যের প্রতি অনাস্থার তত্ত্ব এ দিন মানতে চাননি। তাঁর দাবি, “নির্যাতিতার পরিবারের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে এবং রাজ্যপালকে চিঠি দিয়ে হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছিল। তাই আমরা তদন্ত কমিটি গড়েছি।”
কিন্তু ঘটনা হল, আন্দোলনকারীদের মন পেতে ১৬ সেপ্টেম্বর রাতের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদের প্রতি নরম মনোভাব দেখিয়েছে সরকার। এ দিন সকালে আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রদীপ ঘোষের সঙ্গে দেখা করেন। প্রদীপবাবু বলেন, “উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে ওঁদের জানিয়েছি, যাতে গ্রেফতার হওয়া ৩৭ জনের কেরিয়ারের এবং পড়াশোনার কোনও ক্ষতি না হয়, সে জন্য আইন মোতাবেক কী করা যায়, দেখব।” পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব পড়ুয়া সে দিন আহত হয়েছেন, কর্তৃপক্ষ তার খরচ বহন করবেন বলেও তিনি জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে ছাত্রছাত্রীরা এ দিন জানান, কর্তৃপক্ষ তাঁদের কিছু জানাননি। সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে জানছেন। তবে সত্যি যদি কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তা হলে তাঁদের ‘নৈতিক জয়’ হল বলেই পড়ুয়াদের দাবি।
তাঁরা অবশ্য আন্দোলনের কর্মসূচিও অব্যাহত রাখছেন। কাল, বুধবার ক্যাম্পাসেই হবে নাগরিক কনভেনশন। তাঁদের অভিযোগ, অন্যান্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা বহু পড়ুয়াকে মারধর করা হচ্ছে। সেই সব ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা বৃহস্পতিবার আর একটি মহামিছিল করবে। তার আগে আজ, মঙ্গলবার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস চত্বরে ‘লুঠ ও লাঠির বিরুদ্ধে শিল্পীরা’ শীর্ষক প্রতিবাদের ডাক দিয়েছেন বামপন্থী বিশিষ্টেরা।
প্রতিবাদের মধ্যেই যাদবপুরে স্বাভাবিকতা ফেরানোর চেষ্টাও চলছে। একটি জনস্বার্থ মামলার ভিত্তিতে গত ১৯ তারিখ হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরাতে হবে। প্রদীপবাবু এ দিন বলেন, “কর্তৃপক্ষের তরফে একটি নোটিস জারি করেছি ক্লাস শুরু করার জন্য।” আন্দোলনকারীরা অবশ্য সাধারণ সভা করে জানিয়ে দিয়েছেন, ওই নোটিস তাঁরা মানবেন না। উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন এবং ক্লাস বয়কট চলবে।