সিঙ্গুরের বন্ধ কারখানা
বহু কলকারখানা বন্ধ। চাকরি খুইয়ে শ্রমিকদের কাউকে নিজের বাড়িতেই লেদ মেশিন বসিয়ে, কাউকে আবার ছোটখাটো দোকান খুলে রুটিরুজির ব্যবস্থা করতে হয়েছে। বড় মাপের কারখানা না-খোলায় নতুন চাকরির সুযোগও তৈরি হয়নি। বেকারদেরও ছোটখাটো শিল্প বা ব্যবসা করে রোজগারের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। গ্রাম বা মফস্সলের মানুষ নির্ভর করছেন হস্তশিল্পের উপরে। কিন্তু সেগুলি এত ছোট মাপের যে, তাতেও খুব বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।
পশ্চিমবঙ্গের এই ছবিটাই ফুটে উঠেছে আর্থিক শুমারিতে।
সেই রিপোর্ট বলছে, শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থার সংখ্যায় দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় স্থানে। উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের ঠিক পরেই। গত আট বছরে পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের সংস্থার সংখ্যা প্রায় ৪১ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। কর্মসংস্থানের হিসেবে অনেক এগিয়ে অসম, সিকিম, হিমাচলপ্রদেশ, গুজরাত।
পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়ার কারণ, রাজ্যে এক-একটি সংস্থায় গড়ে দু’জনেরও রোজগারের বন্দোবস্ত না-হওয়া। যার অর্থ স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রোজগারের আশায় ছোটখাটো ব্যবসা করছেন, কারখানা চালাচ্ছেন, দোকান খুলছেন। সেখানে তাঁর, বা খুব বেশি হলে বাড়ির আর এক জনের কাজের সংস্থান হচ্ছে।
দশ বছর অন্তর যেমন জনগণনা হয়, তেমনই ২০০৫ সালে প্রথম বার আর্থিক শুমারি হয়েছিল। দ্বিতীয় আর্থিক শুমারির কাজ শুরু হয়েছে ২০১৩ থেকে। সম্প্রতি তার প্রাথমিক ফল প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রক। এই শুমারিতে গোটা দেশে কতগুলি শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থা রয়েছে, সেখানে কত জন কাজ করছেন, তার হিসেব করা হয়। পরিসংখ্যান মন্ত্রকের সচিব টি সি এ অনন্ত বলেন, “যে কোনও সংস্থা যদি কিছু উৎপাদন করে, বিক্রি করে বা পরিষেবা দেয়, তা হলে সেগুলি আমাদের গণনার আওতায় চলে আসে। সেটা বড় কারখানা হতে পারে, আবার কেউ ঘরেই মেশিন বসিয়ে বা হাতে কিছু তৈরি করছেন কিংবা বাড়ির বারান্দায় দোকান দিয়েছেন, সেটাও হতে পারে।”
আর্থিক শুমারি বলছে, পশ্চিমবঙ্গে এখন এই ধরনের শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থার সংখ্যা ৫৯ লক্ষ ১ হাজার ৫২১টি। গোটা দেশের ১০ শতাংশের বেশি সংস্থা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। গুজরাত, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটকের মতো রাজ্যকে পিছনে ফেলে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
তার মানে কি রাজ্যে বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে?
গোটা দেশে আর্থিক শুমারির পরিকল্পনা তৈরির জন্য পরিসংখ্যান মন্ত্রক একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করেছে। তার চেয়ারম্যান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থার সংখ্যা বেশি হওয়ার অর্থ হল বড় বা ভারী শিল্পের অভাব। যখন একটা বড় কারখানা বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, তখন তার শ্রমিকরা পেট চালাতে ছোটখাটো কারখানা, দোকান খুলে বসেন। তার ফলে এই ধরনের সংস্থার সংখ্যাও এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যায়।
শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থার মোট হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে থাকলেও সেই তুলনায় কর্মসংস্থান কিন্তু হয়নি। পরিসংখ্যান মন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (আর্থিক শুমারি) সুনীল জৈন বলেন, “কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ পিছনের সারির রাজ্যগুলির অন্যতম।” ২০০৫ থেকে ২০১৩-র মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২০.৩৫ শতাংশ। অথচ শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থার সংখ্যা বেড়েছে ৪১ শতাংশ। গুজরাতে এই আট বছরে নতুন শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থার সংখ্যা ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। কর্মসংস্থানও বেড়েছে প্রায় ৫৬ শতাংশ। জাতীয় স্তরেও এই সময়ে ৩৪ শতাংশ কর্মসংস্থান বেড়েছে।
এর কারণ কী? আর্থিক শুমারি বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ছোট মাপের কারখানা বা ব্যবসা হওয়ার ফলে সেগুলিতে কাজ পাওয়া মানুষের সংখ্যা কম। প্রায় ৫৯ লক্ষ শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থায় কাজ করছেন ১ কোটি ১৫ লক্ষের মতো মানুষ। গড়ে একটি সংস্থায় কাজ করা মানুষের সংখ্যা দু’জনেরও কম-১.৯৬। মহিলা কর্মী-শ্রমিকের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে বাংলা। জাতীয় স্তরে যার পরিমাণ ২৫%, রাজ্যে তা ২১%-র কাছাকাছি। শ্যামাবাবুর বক্তব্য, “আর্থিক শুমারির ফলের পর বোঝা যাবে, বাংলায় আগে ক’টি বড় কারখানা বা বাণিজ্য সংস্থা ছিল, এখন ক’টি ছোট সংস্থা হয়েছে।” আর্থিক শুমারির প্রাথমিক ফলেই ইঙ্গিত, রাজ্যে এখন ছোট কারখানা বেশি। স্থায়ী কাঠামোর মধ্যে কারখানা, ব্যবসা চলছে ৩৫% ক্ষেত্রে। ৫৯ লক্ষের বেশি শিল্প বা বাণিজ্য সংস্থার ৩৬% চলছে বসত বাড়িতে। প্রায় ২৯ % কারখানা বা ব্যবসা চলছে বাইরে, কিন্তু তার নির্দিষ্ট কাঠামো নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy