Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

থমকে সময়, সামনে সত্য

চলতে চলতে সময় যেন হঠাৎ থমকে গিয়েছে এখানে। সরু বারান্দার দেওয়ালে ঝোলানো ছোট্ট ঘড়িটার মতো। কবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে কে জানে! তবু আছে, এটাই সত্য। একতলার এই বারান্দাটি বরাবর পর পর ঘর। প্রতিটিই কোনও না কোনও দাশমুন্সি ভাইয়ের জন্য চিহ্নিত। এটা নিখিলের, ওটা ভক্তের, সেটা গোপালের ইত্যাদি। যদিও তাঁরা প্রায় সকলেই কালিয়াগঞ্জের এই পৈতৃক ভিটেতে কার্যত অনাবাসী। কালেভদ্রে উৎসব-অনুষ্ঠানে আসেন।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৯
Share: Save:

চলতে চলতে সময় যেন হঠাৎ থমকে গিয়েছে এখানে। সরু বারান্দার দেওয়ালে ঝোলানো ছোট্ট ঘড়িটার মতো। কবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে কে জানে! তবু আছে, এটাই সত্য।

একতলার এই বারান্দাটি বরাবর পর পর ঘর। প্রতিটিই কোনও না কোনও দাশমুন্সি ভাইয়ের জন্য চিহ্নিত। এটা নিখিলের, ওটা ভক্তের, সেটা গোপালের ইত্যাদি। যদিও তাঁরা প্রায় সকলেই কালিয়াগঞ্জের এই পৈতৃক ভিটেতে কার্যত অনাবাসী। কালেভদ্রে উৎসব-অনুষ্ঠানে আসেন। ‘স্থায়ী’ দাশমুন্সি ভাই এখানে আপাতত এক জনই। তিনি সত্যরঞ্জন। পোশাকি নাম পবিত্ররঞ্জন হিসাবে যিনি এ বার লোকসভার ভোট-প্রার্থী।

সত্যের ঘরের দরজার উপরেই ঝুলছে সময়-থামা ঘড়িটা। ঠিক যেমন দোতলা বাড়িটির আনাচে-কানাচে, অলিন্দে, ঠাকুরদালানে থেমে রয়েছেন তাঁর আর এক দাদা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। সুদূর দিল্লিতে হাসপাতালের বিজন কেবিনে এক প্রিয়রঞ্জন যখন প্রায় জীবন্মৃত অবস্থায়, অন্য এক প্রিয়রঞ্জন তখন এখানে তাঁর উজ্জ্বল অতীত, নিশ্চল বর্তমান এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রবল ভাবে উপস্থিত। সেই দাদাকে আঁকড়ে ধরে দিদি-র দলের প্রার্থী সত্যরঞ্জন নেমেছেন তাঁর জীবনের প্রথম ভোট-ভিক্ষায়।

বাড়ির প্রশস্ত দোতলাটি প্রিয়-ঘরণী দীপার জন্য বরাদ্দ। গৃহিণীর অনুপস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে প্রবেশ নিষেধ। তবে গেটের বাইরে থেকে উপরে এক নজর তাকালে অন্দরমহলের সু-সজ্জার আভাস চোখ এড়ায় না। প্রিয়রঞ্জনের পরে এই ঠিকানা থেকে গত বার লোকসভা ভোটে জিতে দীপা কেন্দ্রে মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন। প্রথম দফা সাংসদ হয়েই কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়ার এমন ভাগ্য খোদ প্রিয়রঞ্জনেরও হয়নি। স্বামীর আকস্মিক অসুস্থতা দীপাকে দ্রুত এই অবস্থানে পৌঁছতে সাহায্য করেছে। কংগ্রেস টিকিটে আরও এক বার ভোটে দাঁড়িয়ে সঙ্গত কারণে তাই তিনিও ঘোরতর প্রিয়-নির্ভর।

নিজে অন্তরালে থাকলেও একতলার সঙ্গে দোতলার এই কৌরব-পাণ্ডব নির্বাচনী যুদ্ধে প্রিয়বাবু,অতএব, কৃষ্ণ। তাঁর ‘দখল’ কে নেবেন, স্ত্রী না ভাই, পাল্লা চলছে তা নিয়ে। বাড়ির ফটকে প্রিয়রঞ্জনের ছবি দেওয়া বিশাল হোর্ডিং লাগিয়ে দীপা লিখেছেন ‘আমি আছি, আমি থাকব। সবাই রয়েছে ঘিরে। সবার মাঝে আমি এক দিন অবশ্যই আসব ফিরে।’ গেটের ঠিক উল্টো দিকের এক বাড়িতে তৃণমূল প্রার্থী সত্যরঞ্জনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দরজায় লাগানো হোর্ডিং ‘দিদির পথে দিদির সাথে স্বপ্নপূরণ করতে হবে। দাদার স্বপ্ন ভাইয়ের হাতে, সত্যদাকে জেতাতে হবে।’ সেখানে মমতার পাশাপাশি প্রিয়রঞ্জনের ছবি।

দাদার স্বপ্ন ও দিদির স্বপ্ন তবে ভোটের বাজারে একাকার? নির্মল হেসে সত্যবাবুর জবাব “একই তো! সব এক। আজ প্রিয়দা অ্যাকটিভ থাকলে রাজনীতি অন্য দিকে যেত। এই সব এত ভাগাভাগি হতোই না, আমি সিওর।” তা হলে তৃণমূলের হয়ে আপনার দাঁড়ানোটাও কি হতো? সত্যরঞ্জন একটু থামলেন। তার পর উদাস ভঙ্গিতে বললেন, “জানেন, প্রিয়দা অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনেই কংগ্রেস আমাকে দাঁড়াতে বলেছিল। সুব্রতদা (মুখোপাধ্যায়) তখন কংগ্রেসে। তাঁকে দিয়ে আমার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু আমি ফিরিয়ে দিই। বলি, দাদাকে ছেড়ে যাব না। হাসপাতালে দাদার পাশে থাকতাম। তার পরে তো বৌদি দাঁড়ালেন।” বৌদি আবার অন্য কথা শুনিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য ২০১১-র বিধানসভা ভোটে সত্যরঞ্জন কংগ্রেসের টিকিট চেয়ে পাননি। লোকে বলে, এর পরেই অভিমান তাঁকে পায়ে পায়ে তৃণমূলের দিকে ঠেলে দেয়।প্রিয়রঞ্জনের খাসতালুক কালিয়াগঞ্জে ইদানিং তৃণমূলের হাওয়া বেশ গায়ে লাগে। মাস কয়েক আগে রায়গঞ্জে জেলা প্রশাসনের বৈঠক করতে এসেছিলেন মমতা। কালিয়াগঞ্জের রাস্তায় ভিড়ের চাপে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় এগিয়ে নিয়ে যেতে নাস্তানাবুদ অবস্থা হয়েছিল পুলিশের। গোটা শহরটাই যেন নেমে এসেছিল পথে। একই ছবি দেখা গিয়েছিল রায়গঞ্জেও। দীপা দাশমুন্সির পাড়ায় এ হেন জনজোয়ারে দৃশ্যতই তৃপ্তি পেয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁর দলের প্রার্থী হয়ে সেই মমতা-আবেগের কিয়দংশ যে এ তল্লাটে সত্যরঞ্জনের প্রাপ্য, তা হয়তো অস্বীকার করা যাবে না। সত্যবাবুও এখন পর্যন্ত রায়গঞ্জ-কালিয়াগঞ্জের বাইরে বড় একটা বেরোননি। ১০ এপ্রিলের পরে বেরোনোর কথা। সকালে কালিয়াগঞ্জ শহরে একদফা পদযাত্রা সেরে এসে গায়ের ঘাম শুকিয়েই রাজ্যের মন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরীকে নিয়ে দ্বিতীয় দফা বেরোনোর প্রস্তুতি চলছিল তাঁর।

বৌদি দীপা অবশ্য ঘুরছেন টইটই করে। চষে ফেলেছেন কেন্দ্রের এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো। গত বার সঙ্গে ছিল প্রিয়-আবেগ। এ বার ঘাড়ের উপর মমতার চাপ, কিছুটা মোদী-হাওয়া, সেই সঙ্গে নিজের পাঁচ বছরের সাংসদ-খতিয়ান দেওয়ার দায়। সব মিলিয়ে তাই এ বারের ভোটটা যে কঠিন, তা মেনে নিতে দ্বিধা নেই দীপার। দেওর সত্যরঞ্জন প্রার্থী হওয়ায় সেই বোঝা কি আরও একটু ভারী হয়ে গেল?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে এ বার রায়গঞ্জে দীপা দাশমুন্সির বিরুদ্ধে সত্যকে দাঁড় করাবেন, সেই কথাটা অনেক দিন ধরেই বাতাসে ভাসছিল। দেওরের কাছে বৌদি এক দিন জানতেও চেয়েছিলেন, “সত্যি দাঁড়াবে?” দাঁড়ানোর পরে কী বললেন বৌদি? “না, কথা হয়নি আর।” জানালেন সত্যরঞ্জন। তবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এতে ক্ষুণ্ণ হবে, সেটা ঘুণাক্ষরেও মানলেন না। “ভোট তো ভোট। বাইরের ব্যাপার। পরিবারে আমার বৌদি তিনি,” বলছেন সত্যরঞ্জন।

বৌদি কিন্তু এতটা উদার হতে রাজি নন। নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকেই কালিয়াগঞ্জের বাড়ি ছেড়ে তিনি অন্যত্র রয়েছেন। দেওরের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষার প্রশ্নেও দীপা অকপট বুঝিয়ে দেন, লড়াইয়ের ময়দানে ওই সব ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুতো বুনতে তাঁর আগ্রহ নেই।

নির্বাচন একটা লড়াই। দেওর হলেও তিনি প্রতিপক্ষই। আর প্রিয়বাবুর ‘ভাই’ হিসাবে? দীপার মন্তব্য, “দাশমুন্সি পদবির জোরটাই বড় কথা নয়। রায়গঞ্জে প্রিয়দা-র অমন অনেক ভাই রয়েছে।”

তাঁর নাম-মাহাত্ম্য স্ত্রী দীপাকে তরাবে, না কি ভাই সত্যকে সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন। কিন্তু স্ব-বশে থাকলে এ সব দেখেশুনে কী বলতেন প্রিয়রঞ্জন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debasish bhattachrya dipa dasmunshi raiganj
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE