Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দলেই দুর্নীতি, তপনের পরে সরব স্বপনকান্তিও

শীর্ষ নেতৃত্ব যতই লাগাম টানার চেষ্টা করুন, দলের হালচালে বিরক্ত তৃণমূল নেতাদের মুখ খোলার প্রবণতা রোখা যাচ্ছে না। শুভবুদ্ধি চেপে রেখে দলের নীতি মানতে হয় বলে দিন তিনেক আগেই কবুল করেছিলেন মন্ত্রী সাধন পান্ডে। দলের নেতার তোলাবাজি নিয়ে মুখ খুলে শীর্ষ নেতৃত্বের ধমক খেয়েছিলেন পূর্বস্থলীর তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়কে। এ বার তাঁকেই পাশে বসিয়ে চড়া সুরে তোপ দাগলেন আর এক বিধায়ক, সিউড়ির স্বপনকান্তি ঘোষ। তাঁর পাশে তখন হাজির সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী।

পূর্বস্থলীর কৃষি এবং শিল্পমেলার মঞ্চে (বাঁ দিক থেকে) শুভেন্দু অধিকারী, স্বপনকান্তি ঘোষ এবং তপন চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

পূর্বস্থলীর কৃষি এবং শিল্পমেলার মঞ্চে (বাঁ দিক থেকে) শুভেন্দু অধিকারী, স্বপনকান্তি ঘোষ এবং তপন চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
পূর্বস্থলী শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪১
Share: Save:

শীর্ষ নেতৃত্ব যতই লাগাম টানার চেষ্টা করুন, দলের হালচালে বিরক্ত তৃণমূল নেতাদের মুখ খোলার প্রবণতা রোখা যাচ্ছে না।

শুভবুদ্ধি চেপে রেখে দলের নীতি মানতে হয় বলে দিন তিনেক আগেই কবুল করেছিলেন মন্ত্রী সাধন পান্ডে। দলের নেতার তোলাবাজি নিয়ে মুখ খুলে শীর্ষ নেতৃত্বের ধমক খেয়েছিলেন পূর্বস্থলীর তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়কে। এ বার তাঁকেই পাশে বসিয়ে চড়া সুরে তোপ দাগলেন আর এক বিধায়ক, সিউড়ির স্বপনকান্তি ঘোষ। তাঁর পাশে তখন হাজির সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী।

সারদা কেলেঙ্কারি থেকে যাদবপুর কাণ্ড, সিবিআই তদন্তে নেতা-মন্ত্রীদের জড়িয়ে যাওয়া থেকে রাজ্যে বিজেপির উত্থান ঘরে-বাইরে জেরবার তৃণমূলের উপরতলায় আগেই মুখ খুলতে শুরু করেন নেতাদের একাংশ। সারদা কাণ্ডে দলের মন্ত্রী গ্রেফতার হওয়া সত্ত্বেও সাংসদ সুগত বসু কার্যত সিবিআই তদন্তের পক্ষেই মুখ খোলেন। যাদবপুরের পড়ুয়ারা সমাবর্তন বয়কট করলে প্রতিবাদের সেই পন্থাকে সমর্থন জানান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়।

শীর্ষ নেতৃত্বের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে দলেরই একাংশের কাজ নিয়ে সরব হওয়ার সেই প্রবণতা যে পরের ধাপেও চারিয়ে গিয়েছে, বৃহস্পতিবার বর্ধমানের পূর্বস্থলী থানার মাঠে কৃষি ও শিল্প মেলার শেষ দিনে কার্যত সেটাই স্পষ্ট হয়ে গেল। যেখানে বক্তৃতার শুরুতেই স্বপনকান্তি বললেন, “এক ধরনের কর্মী মনে করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ দেখিয়েই রাজ্যে ২০ বছর থেকে যাবেন। কিন্তু আমরা যদি মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, কেউ যদি বামেদের মতো তোলাবাজি শুরু করে, দলের ভবিষ্যৎ খারাপ হবে। তপন চট্টোপাধ্যায় এই ধরনের কাজের প্রতিবাদ করেছিলেন।”

স্বপনবাবু কারও নাম না করলেও তিনি যে পূর্বস্থলীরই এক নেতার বিরুদ্ধে তপনবাবুর আনা তোলাবাজির অভিযোগের কথা বলতে চেয়েছেন, তা পরিষ্কার। তিনি বলেন, “কেউ-কেউ তোলা তুলে দলের নেতা হতে চাইবেন আর তপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো লোকেরা পূর্বস্থলীর উন্নয়নের জন্য ঝোলা কাঁধে কলকাতার এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে বেড়াবেন, সেটা হতে পারে না। আমরা যখন কাগজে তপনবাবুর চিঠির কথা পড়ি, লজ্জায় মুখ ছোট হয়ে গিয়েছিল।”

একের পর এক বক্তব্যে যত বেশি আক্রমণাত্মক হয়েছেন বীরভূমের এই নেতা, হাততালিতে ফেটে পড়েছেন তৃণমূলের সাধারণ নেতাকর্মীরা। ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছেন মেলার মাঠে হাজির অনেক সাধারণ মানুষও। যা থেকে পরিষ্কার, অসন্তোষটা তৃণমূল স্তর পর্যন্তই ছড়িয়েছে। কেননা সারদা কেলেঙ্কারি বা শিল্প আনতে তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সাধারণ মানুষ যখন প্রশ্ন তুলছেন, নরেন্দ্র মোদীর গুজরাতের সঙ্গে এ রাজ্যের দুরবস্থার তুলনা করছেন, নীচতলার নেতা-কর্মীদেরই তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে কোনও সদুত্তর তাঁদের কাছে নেই। উল্টে সারদাকাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া মন্ত্রী বা ছাত্রছাত্রীদের ঘেরাও তুলতে পুলিশ-ডাকা উপাচার্যকে আড়াল করার যে চেষ্টা দল চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে তাঁরা আরও বেকায়দায় পড়ছেন।

এর ফলে নীচের তলায় যে ক্ষোভ এবং হতাশা তৈরি হচ্ছে তার ফয়দা নিচ্ছে বিজেপি। নীচতলার তৃণমূল নেতাকর্মীরা অনেকেই গেরুয়া শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছেন। স্বপনবাবুর মতো নেতারা মনে করছেন, দলনেত্রীর নাম করে কিছু নেতা যে সব কুকর্ম করে চলেছেন, তাতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে। কর্মীদের সতর্ক করে স্বপনবাবু বলেন, “জানবেন, তৃণমূলের ক্ষতি করার ক্ষমতা বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস কারও নেই। এক মাত্র ক্ষতি যদি কেউ করে থাকে, দলের কতিপয় নেতাই ক্ষতি করেছেন।”

আগের বার দলের নেতার দুর্নীতি নিয়ে সরব হতে গিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের বিরাগভাজন হন তপন চট্টোপাধ্যায়। প্রকাশ্যে মুখ খোলায় তাঁকে ফোন করে সতর্ক করেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। স্বপনকান্তির বক্তব্য প্রসঙ্গে রাতে তিনি বলেন, “দলের তরফে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে যে কোনও ব্যাপারে বা কারও কাজকর্মে প্রশ্ন বা অভিযোগ থাকলে তা দলের মধ্যেই জানাতে হবে। ওই বিধায়ক যদি সত্যিই এমন কথা বলে থাকেন, তবে দলের কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। আমরা লিখিত ভাবে তাঁর বক্তব্য জানতে চাইব।”

স্বপনকান্তির পরে বক্তৃতা করতে উঠেই শুভেন্দু অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, “স্বপনদা বরাবরই প্রতিবাদী চরিত্রের।” নেতাকর্মীদের প্রতি তাঁরও পরামর্শ, “ভাল কাজের পক্ষে থাকবেন, প্রশংসা করবেন। খারাপ কিছু হলে দূরে থাকবেন।” তবে স্বপনবাবুর খেদ, দলীয় কোন্দলের জেরে শুভেন্দুর মতো নেতাদের অবদান মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। তাঁর কথায়, “দুঃখ হয়, যখন দেখি আমাদের দলের কোনও-কোনও শীর্ষ নেতা নন্দীগ্রামের ইতিহাস থেকে শুভেন্দু অধিকারীর নাম মুছে দিতে চায়। আমরা চাই শুভেন্দু অধিকারীর মতো প্রতিবাদী, তরতাজা তরুণেরা এ বার দলের নেতৃত্বে এগিয়ে আসুন।”

পার্থবাবু গত দু’দিন কোচবিহার এবং জলপাইগুড়িতে সাধারণ কর্মীদের মর্যাদা দেওয়ার যে কথা বলেছেন, সেই সুরই এ দিন দুই নেতার গলায় শোনা গিয়েছে। বাম জমানার অবসান ঘটাতে যে সাধারণ কর্মীরা অত্যাচারিত হয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন তা মনে করিয়ে দিয়ে স্বপনকান্তি বলেন, “ওঁদের অবদানকে ছোট করে দেখলে হবে না। জানতে হবে, ছোট-ছোট কর্মী থেকেই এক জন নেত্রীর জন্ম হয়। কর্মীদের বাদ দিয়ে একা একটা দলকে টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE