Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দলের জোরেই ভোট আকাশে ঝলমলে তারারা

তালিকা ধরে পরপর দলীয় প্রার্থীদের নাম পড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এক জনের নাম বলার আগে রীতিমতো উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ঘাটাল কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী। নাম: দীপক অধিকারী। ৫ মার্চ। ৩০-বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে বসে লোকসভা ভোটের প্রার্থী তালিকা সে দিন ঘোষণা করছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। উচ্ছ্বসিত হয়ে ওই নামটা উচ্চারণ করে মমতা বলেন, “দীপক অধিকারী মানে আমাদের দেব। জানেন তো, ওর বাড়ি কিন্তু কেশপুরে। ওকেই ঘাটালে প্রার্থী করলাম।”

জয়ের শংসাপত্র নেওয়ার পরে দেব। ছবি:  সৌমেশ্বর মণ্ডল।

জয়ের শংসাপত্র নেওয়ার পরে দেব। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৪ ০৩:১১
Share: Save:

তালিকা ধরে পরপর দলীয় প্রার্থীদের নাম পড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এক জনের নাম বলার আগে রীতিমতো উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ঘাটাল কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী। নাম: দীপক অধিকারী।

৫ মার্চ। ৩০-বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে বসে লোকসভা ভোটের প্রার্থী তালিকা সে দিন ঘোষণা করছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। উচ্ছ্বসিত হয়ে ওই নামটা উচ্চারণ করে মমতা বলেন, “দীপক অধিকারী মানে আমাদের দেব। জানেন তো, ওর বাড়ি কিন্তু কেশপুরে। ওকেই ঘাটালে প্রার্থী করলাম।”

ঠিক দু’মাস এগারো দিন পর দেখা গেল, টলিউডের তারকা সেই দেব বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে লোকসভায় যাচ্ছেন। শুধু দেব নন, তাঁর সঙ্গেই সাংসদ হলেন তৃণমূলের আরও ছয় তারকা প্রার্থী— সন্ধ্যা রায়, মুনমুন সেন, তাপস পাল, শতাব্দী রায়, নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ এবং প্রাক্তন ফুটবলার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। সেলিব্রিটি বা তারকা প্রার্থী বলতে যাঁদের বোঝায়, তেমন ১০ জনকে এ বার লোকসভা ভোটে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। বাকি তিন জন গায়ক ইন্দ্রনীল সেন ও সৌমিত্র রায় এবং ভারতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক ভাইচুং ভুটিয়া হেরেছেন।

বিজেপি দাঁড় করিয়েছিল ছ’জন তারকাকে। সুরকার বাপ্পি লাহিড়ী, অভিনেতা নিমু ভৌমিক, জর্জ বেকার ও জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, জাদুকর পি সি সরকার (জুনিয়র) এবং গায়ক বাবুল সুপ্রিয়। বাবুল সুপ্রিয় বাদে কারও ভাগ্যেই শিকে ছেঁড়েনি।

অর্থাৎ রাজ্যে এ বারের ১৬ জন তারকা প্রার্থীর মধ্যে জিতলেন আট জন। যাঁর মধ্যে সাত জনই তৃণমূলের। যা কিনা লোকসভা ভোটের ফলে রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের আধিপত্যের সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ। অর্থাৎ কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ যখন ঘাসফুলে ছয়লাপ, তখন ঘাসফুল প্রতীকে দাঁড়ানো তারকা প্রার্থীরাই অন্য দলের তুলনায় বেশি জিতেছেন, বাসুদেব আচারিয়া বা বংশগোপাল চৌধুরীর মতো পোড় খাওয়া হেভিওয়েট নেতারা তাঁদের কাছে ধরাশায়ী। আবার একই সঙ্গে দল ও সংগঠনের জোর ছাড়া শুধু নিজের গ্ল্যামারে বাজিমাত করা যে শক্ত, সেটাও অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

গোটা দেশের ছবিও একই কথা বলছে। কংগ্রেসের ভরাডুবির বাজারে হেরেছেন নগমা, মহমম্দ কাইফ, আজহারউদ্দিন, ভোজপুরী তারকা রবি কিষেণ, রাজ বব্বর। আপের প্রার্থী হয়ে হেরেছেন গুল পনগ আর জাভেদ জাফরি। অন্য দিকে বিজেপির পুরনো তারকা হেমা মালিনী, শত্রুঘ্ন সিংহ, বিনোদ খন্নারা তো জিতেইছেন। আনকোরা পরেশ রাওয়াল এবং কিরণ খেরও জিতে গিয়েছেন।

রাজ্যে চারটি প্রধান দলের শীর্ষ নেতারা মানছেন, তারকা হলে পরিচিতির জোরে প্রচারের সময়ে কিছুটা সুবিধে পাওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু দল ও সংগঠনের জোর এবং সেই দলের প্রতি মানুষের সমর্থন না থাকলে তিনি জিততে পারেন না। তাই গত বিধানসভা ভোটে পরিবর্তনের ঝড়ে জিতেছিলেন উত্তরপাড়ার তৃণমূল প্রার্থী গায়ক অনুপ ঘোষাল। সেই ঝড়েই রায়দিঘিতে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো নিচুতলার মাটি কামড়ে পড়ে থাকা সিপিএম নেতাকে হারিয়ে চমক দেন দেবশ্রী রায়। আবার একই অঙ্কে এ বার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দাপটে দার্জিলিং কেন্দ্রে গোল করতে পারেননি ভাইচুং ভুটিয়া। তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় মানছেন, “দলীয় সংগঠন না থাকলে তারকার পক্ষে শুধু তাঁর পরিচিতির জোরে জেতা সম্ভব নয়।”

তাই কি? বিজেপি নেতা তথাগত রায় বলছেন, “উত্তমকুমার হলে আলাদা কথা। তিনি হয়তো নির্দল দাঁড়ালেও জিততেন। তা বলে মুনমুন সেন এ বার এসইউসি-র হয়ে দাঁড়ালে জিততে পারতেন কি!”

প্রচারে মুনমুনের কেন্দ্র বাঁকুড়ায় সিপিএমের জেলা সম্পাদক তথা পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র বলতেন, তারকা প্রার্থীর বদলে রাজনৈতিক প্রার্থীকে জেতালে যে মানুষের লাভ, সেটা বোঝাতে তাঁরা সংসদে তাপস পাল ও শতাব্দী রায়ের সঙ্গে বাসুদেব আচারিয়ার ভূমিকার তুলনা টানছেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি, সেটা ফলেই স্পষ্ট। যে কারণে সন্ধ্যা রায় মেদিনীপুরে হারাতে পেরেছেন সিপিআইয়ের প্রবোধ পণ্ডাকে। কংগ্রেস নেতা ওমপ্রকাশ মিশ্র সে জন্যই বলছেন, “লোকসভা ভোটে রাজ্যে তৃণমূলের সার্বিক জয় হয়েছে। তাই তাদের অধিকাংশ তারকা প্রার্থীই জিতেছেন।” ওমপ্রকাশবাবু এ বার যে কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরেছেন, সেই বালুরঘাটে জিতেছেন তৃণমূলের তারকা প্রার্থী অর্পিতা ঘোষ।

সিপিএম তথা ফ্রন্ট একটি আসনেও তারকা প্রার্থী দেয়নি। তারকার চেয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে প্রার্থী করলে জনতার সুবিধে হবে বলে প্রচারও করেছিল তারা। অতীতে কিন্তু পার্টি বুলা চৌধুরী বা জ্যোতির্ময়ী শিকদারের মতো ক্রীড়াবিদকে টিকিট দিয়েছিল। ২০০৬-এ নন্দনপুর বিধানসভা আসনে জেতেন বুলা। ২০০৪-এ রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে জেতেন জ্যোতির্ময়ী। আরও আগে জিতেছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো তারকা। আবার ২০০৬-এর বিধানসভা ভোটে তাপস পালের কাছে হেরেছিলেন বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। তার আগে ১৯৯৬ সালে কাশীপুরে হেরেছিলেন অনুপ কুমার।

এ বার রাজ্যে জয়ী দুই বাম প্রার্থীর এক জন সিপিএমের মহম্মদ সেলিম। তিনি বলছেন, “আমরা, বামপন্থীরা নিছক তারকার পরিচিতি দেখেই প্রার্থী করি না। তিনি আন্দোলনে কতটা যুক্ত, সেটাও বিচার করা হয়।” সেলিমের কেন্দ্রে তারকা প্রার্থী ছিলেন বিজেপি-র নিমু ভৌমিক। এমনকী দু’-একটি রাউন্ডে নিমুবাবু এগিয়েও গিয়েছিলেন সেলিমের চেয়ে। কিন্তু সেলিমও মনে করেন, তারকার পরিচিতিটা বাড়তি সুবিধে মাত্র। সংগঠন বা দলের অবস্থা ভাল না থাকলে জয় অসম্ভব। অতীতে যে কারণে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে সাবেক উত্তর-পূর্ব কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে হেরেছিলেন অভিনেত্রী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়। আর এক অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় ২০০১-এ বিধানসভা ভোটে যাদবপুরে তৃণমূলের টিকিটে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে হেরে যান। বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়ে হেরেছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

এ বার যেমন বহরমপুরে তৃণমূল প্রার্থী গায়ক ইন্দ্রনীল সেন সাড়ে তিন লাখেরও বেশি ভোটে হেরেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কাছে। তৃণমূলের আর এক গায়ক প্রার্থী সৌমিত্র রায় হেরেছেন কংগ্রেসের আর একটি গড় মালদহ (উত্তর) কেন্দ্রে। সংগঠনের হাল জোরদার ছিল না বলেই নরেন্দ্র মোদী বিরাট জনসভা করে যাওয়া সত্ত্বেও শ্রীরামপুরে জিততে পারেননি বাপ্পি লাহিড়ী।

অথচ আসানসোলের কঠিন লড়াইয়ে জিতেছেন বাবুল সুপ্রিয়। কেন? পার্থবাবুর মতে, আসানসোল কেন্দ্রের অবাঙালি ও হিন্দিভাষীদের বড় অংশ বাবুলকে ভোট দিয়েছেন। বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের দাবি, “আসানসোলে আমাদের সাংগঠনিক জোর আছে। আর মিথ্যা মামলায় বাবুলকে ফাঁসিয়ে তাঁকে হেনস্থা করা হয়েছিল। বাবুল সেই সহানুভূতির ভোট পেয়েছেন।” সেই সঙ্গে তারকার বেড়ায় আটকে না থেকে একেবারে রাজনৈতিক ভাবেই লড়াইটা লড়েছেন বাবুল। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও শুধু তারকা পরিচিতিটা যথেষ্ট নয় বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

surbek biswas deb
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE