বিপর্যয়ের পরে বাইরে থেকে দলের সদর দফতরে কামান দাগা হচ্ছিল। এ বার দলের সদর দফতরের অন্দরেই গোলাগুলি বর্ষণ হল!
লোকসভা ভোটে বেনজির ভরাডুবির পরে সিপিএমের প্রথম রাজ্য কমিটির বৈঠকই সরগরম হল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে লাগাতার তোপে। কেউ বললেন, ‘প্রতিবন্ধী’ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীকে দিয়ে কাজ চালানো দুরূহ। কেউ বললেন, দিল্লিতে বিকল্প সরকারের জন্য জোড়াতালি দিয়ে তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয় দেখেও একই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে কেন? কেউ আবার আপৎকালীন পরিস্থিতিতে গোটা রাজ্য কমিটিই ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন! সবাই সরাসরি নাম করে সমালোচনায় না গেলেও আক্রমণ থেকে রেহাই পেলেন না প্রকাশ কারাট, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা সূর্যকান্ত মিশ্রদের কেউই।
পরাজয়ের পর্যালোচনার জন্য সোমবার থেকে আলিমুদ্দিনে দু’দিনের রাজ্য কমিটির বৈঠকে উপস্থিত আছেন দলের সাধারণ সম্পাদক কারাট ও আরও দুই পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি ও মানিক সরকার। রয়েছেন এ রাজ্য থেকে নির্বাচিত সাংসদ তপন সেনও। তাঁদের সামনেই এ দিন রাজ্য কমিটির একের পর সদস্য সব স্তরের নেতাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রয়াত জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনেন। ভোটের প্রচারে কৌশল নির্ণয়ে ভুলের কথা বলেছেন। সিপিএম সূত্রের খবর, নেতৃত্বকে তোপ দাগার তালিকায় এ দিন প্রথম সারিতে ছিলেন তিন প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান, শমীক লাহিড়ী ও নেপালদেব ভট্টাচার্য, দুই প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য ও মানব মুখোপাধ্যায়। বাদ যাননি বর্ধমানের জেলা সম্পাদক অমল হালদারও। আবার এর বিপরীতে নেতৃত্বের সমর্থনে উঠে দাঁড়িয়েছেন দুই পরাজিত প্রার্থী বাসুদেব আচারিয়া ও অসীম দাশগুপ্ত এবং দুই জেলা সম্পাদক সুমিত দে ও বিপ্লব মজুমদার।
বৈঠকের শেষ দিনে আজ, মঙ্গলবার জবাবি বক্তৃতা করার কথা রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু এবং কারাট, দু’জনেরই। মুখ খুলতে পারেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুও। দিনভর আক্রমণের পরে নেতা-কর্মীদের আস্থা ফেরাতে তাঁরা কী বলেন, সেই দিকে নজর রয়েছে গোটা সিপিএম এবং বামফ্রন্টেরও। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য অবশ্য বলেন, “ফলাফলের পর্যালোচনায় খোলাখুলি মতপ্রকাশকেই আহ্বান জানানো হয়। এতে নতুন কিছু নেই!”
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বৈঠকে এ দিন অমলবাবু ছাড়া জেলা সম্পাদকেরা কেউ বিশেষ রাজ্য বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকে সরাসরি আঙুল তোলেননি। কারণ, লোকসভা ভোটের ফলাফলে সব জেলা একই রকম বিধ্বস্ত! জীবেশ সরকার বা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো জেলা স্তরের প্রথম সারির নেতারা অবশ্য দলের ভুল লাইনের কথা বলেছেন। নেতৃত্ব নিয়ে তুলনায় বেশি সরব হয়েছেন সেই ধরনের নেতারা, যাঁরা নানা কারণে বেশ কিছু দিন ধরেই দলের কাজকর্মে ক্ষুব্ধ বা অভিমানী। দলীয় সূত্রের খবর, ব্যক্তিগত আক্রমণ সরিয়ে রেখে ঝাঁঝালো বক্তব্যে বিমানবাবুদের বেশি কোণঠাসা করে দেন মইনুলই। তাঁর যুক্তি, এখনকার রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর দুই সদস্য ইতিমধ্যে প্রয়াত। দু’জন অসুস্থ। আরও তিন জন নিজেরা প্রার্থী হওয়ায় তাঁদের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল নিজেদের কেন্দ্রেই। বাকিদের মধ্যে বুদ্ধবাবু শারীরিক কারণে সব জায়গায় যেতেই পারেন না। এত প্রতিবন্ধী সম্পাদকমণ্ডলী নিয়ে কী লাভ? তার চেয়ে সব নতুন করে গড়লে এর চেয়ে খারাপ আর কী হবে? দলের সাধারণ সম্পাদককে ইঙ্গিত করে তিনি এ-ও বলেন, এ বারের বিপর্যয় প্রকাশ কারাট থেকে মইনুল হাসান সকলের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে! অথচ নতুন মুখ তুলে আনার প্রয়াস হচ্ছে কই? কেন্দ্রীয় কমিটিতেই বা ক’টা তরুণ মুখ আছে?
এই সুরেই শমীক প্রশ্ন তোলেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর কার্যকারিতা নিয়ে। সম্পাদকমণ্ডলী ভেঙে দেওয়ার দাবিও তোলেন তিনি। অশোকবাবু সরব হন ভোটের ফলে বিপর্যয়ের দিনও রাজ্য সম্পাদকের সাংবাদিক সম্মেলনের ভঙ্গি নিয়ে। কলকাতার নেতা মানববাবু বলেন, আমার দায় না তোমার দায় এই নিয়ে বিতর্ক না বাড়িয়ে গোটা রাজ্য কমিটিটাই আপাতত ভেঙে দেওয়া হোক। পরে আবার তা নতুন করে নির্বাচিত হয়ে আসুক সম্মেলনে। বর্ধমানের অমলবাবু কায়দা করে বলেন, প্রয়োজনে দল তাঁকে সরিয়ে দিক। সেই সঙ্গে সরে দাঁড়ান রাজ্য নেতৃত্বও। আর নেপালদেব দাবি করেন, বুথভিত্তিক মানুষের সঙ্গে কথা বলে তিনি দেখেছেন, বাঙালি সিপিএমকে দিল্লির জন্য বিশ্বাস করতে চাইছে না কেন্দ্রীয় স্তরে তেমন বাঙালি নেতা নেই বলে। বসু প্রয়াত, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্যের ইঙ্গিত ছিল স্পষ্টতই কারাটের দিকে। কারাট-বিমান-বুদ্ধের মতো না হলেও সমালোচনার তির এসেছে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুর দিকেও। নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বেশি সরব হলেও বিজেপি-র বিপদ বোঝাতে কেন তিনি আরও সক্রিয় হলেন না, উঠেছে সেই প্রশ্নও।
বাসুদেববাবু, অসীমবাবুরা অবশ্য এর মধ্যেই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এ বার যে পরিস্থিতিতে বিপর্যয় হয়েছে, তার জন্য শুধু নেতৃত্বকে দায়ী করা অযৌক্তিক। সুমিতবাবু বা বিপ্লববাবুর মতো জেলা সম্পাদকেরাও নেপাদেবদের পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন, হাতে-গোনা সাংসদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্বে বসতে যাওয়া বিচক্ষণ কাজ হতো না। এখন আর সেই প্রসঙ্গ টেনে লাভও নেই।
যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মধ্যেও কারাটকে কিন্তু সারা দিন বসে শুনতে হয়েছে, বিকল্প শক্তির সরকার গঠনের জন্য তাঁদের উদ্যোগ দলের মধ্যেই কতটা গুরুতর প্রশ্নের মুখে! শুনতে হয়েছে সেই পরমাণু চুক্তির কথা। কথা উঠেছে, পরমাণু চুক্তি খায় না মাথায় দেয়, তা-ই লোকে ঠিক করে বুঝল না! আর তার জন্য দলটাকে এখন অনুবীক্ষণ দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে! একের পর এক জেলার নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, যে সব আঞ্চলিক দলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নানা সংশয় আছে, তাদের একজোট করে ভোটের আগে প্রতি বার বিকল্প খাড়া করার চেষ্টার কী অর্থ?
সিপিএমেরই একাংশে অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন আছে, কংগ্রেস ও বিজেপি-র থেকে দূরত্বে দাঁড়িয়ে বিকল্প সরকার ছাড়া বামেরা আর কী-ই বা বলতে পারত? কংগ্রেস এবং বিজেপি ছাড়া সরকার গড়ায় নির্ণায়ক ভূমিকা নেওয়ার কথা বলেই তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৩৪টি আসন পেয়েছেন! কারাটের লাইনের সমালোচনা যাঁরা করছেন, তাঁদের বিকল্প প্রস্তাবটা কী? দলের এই অংশের মতে, পরাজয়ের গ্লানিতে কিছু নেতা এমন বিষয়কে বড় করে দেখাচ্ছেন, যেটা হয়তো বিপর্যয়ের মূল কারণ নয়। এই পরিস্থিতিতেই আজ জবাব দিতে হবে বিমান-কারাটদের।