এত দিন সাধারণ পুলিশকর্মীদের উপরে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেয়নি লালবাজার। এ বার চার আইপিএস অফিসারের নিগ্রহের ঘটনা নিয়েও তদন্ত করতে দিচ্ছে না নবান্ন। যদিও এ ক্ষেত্রে হামলার অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল একটি সংখ্যালঘু সংগঠনের ডাকে জমায়েত হওয়া জনতার একাংশের বিরুদ্ধে।
শনিবার ধর্মতলার সভায় আসা জনতার হাতে চার আইপিএস অফিসার নিগৃহীত হওয়ার ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাতটি ধারায় মামলা করেছিল লালবাজার। ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানিয়েছিল নবান্নেও। কিন্তু প্রশাসনের সবুজ সঙ্কেত এখনও মেলেনি। তাই ঘটনার চার দিন পরেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশ সূত্রের খবর, ওই দিন মারমুখী জনতার সামনে পড়ে চার আইপিএস অফিসার প্রাণ বাঁচাতে ময়দানের একটি ক্লাব তাঁবুতে ঢুকে পড়েছিলেন। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে বেরিয়ে আসেন তাঁরা। প্রশ্ন হল, যারা পুলিশের এমন অবস্থা করল, তাদের পুলিশ ধরতে পারল না কেন? লালবাজারের কর্তারা তাকিয়ে আছেন নবান্নের দিকে। সেখান থেকে সবুজ সঙ্কেত আদৌ আসবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে লালবাজার।
কেন? এত দিন বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশের গায়ে হাত পড়লেও অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেনি পুলিশ। অভিযোগ ছিল, হামলাকারীরা শাসক দলের লোক হওয়াতেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। যেমন আলিপুর থানায় হামলার ঘটনায় লালবাজারের নির্দেশে অভিযুক্ত তৃণমূলীদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হওয়ায় উল্টে এক বিভাগীয় ডিসি-কে বদলি করা হবে বলে ‘সতর্ক’ করেছিল লালবাজার। সার্জেন্ট নিগ্রহে গরফায় তৃণমূল কাউন্সিলরকেও গ্রেফতার করতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু আইপিএস নিগ্রহের ঘটনার পিছনে তো তৃণমূলীদের নাম নেই। তা হলেও কেন ঠুঁটো হয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে? নবান্নের অন্দরের খবর, ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির দিকে তাকিয়েই এ ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দিচ্ছে না রাজ্য সরকার।
এক প্রাক্তন পুলিশকর্তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বছর কয়েক আগে একটি ঘটনার কথা। তিনি বলছেন, “সে বার এমন একটি জমায়েতে যুগ্ম কমিশনার পদের এক অফিসার মার খেয়েছিলেন। সে বারও কাউকে গ্রেফতার করতে দেননি প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা।” তাঁর মতে, সে বারও ভোটের অঙ্কই ছিল কারণ। যার জেরে পুলিশের মুখ বুজে মার খাওয়ার ঘটনা একটি রীতি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এবং দিনদিন আরও বাড়ছে।
শনিবারের ঘটনায় অবশ্য নিজেদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে লালবাজারে। তাঁরা বলছেন, গত শনিবার সমাবেশের গোড়া থেকেই পুলিশকে উস্কে অশান্তি বাধানোর চেষ্টা করছিলেন জমায়েতকারীদের একাংশ। পুলিশের উপরে ইটবৃষ্টি হওয়ার পরে নবান্নের কয়েক জন কর্তা বলছেন, শহিদ মিনার ও আশপাশের এলাকায় অত ইট এল কোথা থেকে? সেখানে তো কোনও নির্মাণকাজ চলছিল না। তা হলে কি গোলমাল পূর্বপরিকল্পিত? সে ক্ষেত্রে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা আগাম খবর পেলেন না কেন, তা জানতে চাইছেন ওই কর্তারা।
গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা মেনেও নিচ্ছেন লালবাজার একাংশ। তাঁরা বলছেন, শনিবার দুপুরে এক পুলিশ কনস্টেবল আক্রান্ত হয়েছেন শুনে এক যুগ্ম কমিশনার গাড়ি নিয়ে মেয়ো রোডে ঢোকেন। পুলিশের গাড়ি ওই রাস্তায় ঢুকল কেন, সে প্রশ্ন তুলে তাঁকে ঘিরে ধরে এক দল লোক। চালক কোনও মতে গাড়ি ঘুরিয়ে লালবাজারের দিকে চলে যান। তার পরেই রটে যায়, পুলিশের গাড়ির ধাক্কায় এক শিশু আহত হয়েছে। সেই খবর রটতেই এক দল লোক পুলিশ স্মারক সৌধের কাছে এক কনস্টেবলকে ঘিরে ধরেন।
লালবাজার সূত্রের খবর, সেই সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছন তিন আইপিএস-কর্তা। ওই পুলিশকর্মীকে ছাড়াতে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনার পরিবেশ বজায় রাখতেই ওই সময়ে পুলিশকর্তারা পর্যাপ্ত বাহিনী সঙ্গে রাখেননি। কিন্তু তাতে ফল হয় বিপরীত। আচমকা ইট বৃষ্টি শুরু হয় পুলিশের উপরে। এক ডিসি-র মাথায় ইট পড়ে। আর এক পুলিশকর্তার ডান পায়ের সিনবোনে ইটের আঘাত লাগে। উল্টো দিক থেকে মারমুখী মেজাজে কিছু লোক ছুটে আসছিল। তখনই পুলিশকর্তারা প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে থাকেন। আশ্রয় নেন একটি ক্লাবে।
কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ অবশ্য ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁর বাহিনীর কাজের প্রশংসাই করেছেন বলে লালবাজারের খবর। পুলিশ সংযত না-থাকলে সে-দিন স্পর্শকাতর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত বলে তিনি মনে করেন। কমিশনারের মতামত সরাসরি অবশ্য পাওয়া যায়নি। সকালে ফোন ধরে তিনি বলেন, “এখন অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। পরে কথা বলব।” এর পরে আর ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি। বর্তমান পুলিশ কর্তাদের মধ্যে আরও কেউ কেউ মানছেন, “পুলিশ পাল্টা মারের রাস্তায় হাঁটলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হত।” আবার কারও কারও মতে, পুলিশের শিরদাঁড়াটাই অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। “অকেজো শিরদাঁড়া নিয়ে লড়াই করতে যাওয়া অনেক বেশি বোকামির কাজ!” মন্তব্য এক কর্তার।
এ যুক্তি মানতে নারাজ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তাদের একাংশ। কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার বলেন, “পুলিশকর্তাদের পালিয়ে বাঁচাটা লালবাজারের ভাবমূর্তির পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন নয়।” আর এক প্রাক্তন কর্তা বলছেন, “মার খেয়ে এসে এ সব যুক্তি দিয়ে মুখ রক্ষা চলে না।” পুরনো একটি ঘটনার কথা তুলে ধরে ওই প্রাক্তন কর্তার মন্তব্য, বছর কয়েক আগে তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে শহরে যে হাঙ্গামা হয়েছিল, সেই ঘটনায় তৎকালীন কংগ্রেস নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল কলকাতা পুলিশ। সেই কংগ্রেস নেতা এখন দল বদলে তৃণমূলের উপরতলায় উঠে এসেছেন, সাংসদও হয়েছেন। দল বদলানোর পরেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করে নেয় রাজ্য সরকার।
ওই প্রাক্তন কর্তার প্রশ্ন, “বাহিনীর প্রতি সহমর্মিতা থাকলে সাংসদের বিরুদ্ধে মামলা তোলার ক্ষেত্রে আপত্তি জানানো হয়নি কেন?” একই সুর কলকাতা পুলিশের নিচু ও মাঝারিতলার অনেক অফিসারেরও। এক পুলিশ অফিসার বলছেন, “ওই মামলা তোলার দিন থেকেই আমাদের দুর্দশা শুরু হয়ে গিয়েছিল।”
লাগাতার এমন ঘটনায় পুলিশের মনোবল একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে বলেই মনে করেন কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, “এমন নজির তো এখন রোজই তৈরি হচ্ছে। তাপস পালের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আমি কি ওকে খুন করব!’ খুন করতে কেউ বলেনি। কিন্তু অপরাধের প্রতি নরম মনোভাব নিলে চলবে না।”
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, স্বাধীন ভাবে কাজ করতে না-পারাই পুলিশকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি বাড়ছে। “সাধারণ মানুষের প্রধান ভরসা পুলিশ। তারই এমন দশা হলে, মানুষ কোথায় যাবে”, বলছেন অশোকবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy