Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রার্থী বাছাই কি দুর্বল, প্রশ্নের মুখে কংগ্রেস

কোনও ভাবেই তৃণমূলের সঙ্গে জোট নয়, লোকসভা ভোটের বহু আগে থেকেই দলের হাইকম্যান্ডের কাছে আর্জি জানাচ্ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা। শেষ পর্যন্ত সেই আর্জিতেই সম্মতি দিয়েছেন সনিয়া গাঁধী-রাহুল গাঁধী। কিন্তু লড়তে নেমে কোথাও কোথাও কি আগেই কিছুটা ময়দান ছেড়ে দিয়ে বসে আছে প্রদেশ কংগ্রেস? ভোটের হাওয়া যত গরম হচ্ছে, এই জল্পনাও ঘুরপাক খাচ্ছে কংগ্রেসের ভিতরে-বাইরে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০৭
Share: Save:

কোনও ভাবেই তৃণমূলের সঙ্গে জোট নয়, লোকসভা ভোটের বহু আগে থেকেই দলের হাইকম্যান্ডের কাছে আর্জি জানাচ্ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা। শেষ পর্যন্ত সেই আর্জিতেই সম্মতি দিয়েছেন সনিয়া গাঁধী-রাহুল গাঁধী। কিন্তু লড়তে নেমে কোথাও কোথাও কি আগেই কিছুটা ময়দান ছেড়ে দিয়ে বসে আছে প্রদেশ কংগ্রেস? ভোটের হাওয়া যত গরম হচ্ছে, এই জল্পনাও ঘুরপাক খাচ্ছে কংগ্রেসের ভিতরে-বাইরে।

এমন জল্পনার কারণ মূলত রাজ্যের বেশ কিছু কেন্দ্রে প্রার্থী বাছাই। কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একাংশের মধ্যে যেমন প্রার্থী নিয়ে অসন্তোষ আছে, তেমনই পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে সন্দিহান হয়ে পড়েছে বাম শিবিরও। সিপিএম রাজ্য নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন বলছে, উপরে কোনও জোট না-থাকলেও তলে তলে কিছু জায়গায় কংগ্রেস এবং তৃণমূলের সমঝোতা হয়েছে। মালদহ, মুর্শিদাবাদের মতো কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটিতে তাদের বেকায়দায় ফেলার মতো প্রার্থী দেয়নি তৃণমূল। দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূলের ভোট কেটে শাসক দলকে অস্বস্তিতে ফেলার বদলে কংগ্রেস বেশ কিছু ‘দুর্বল’ প্রার্থী দিয়েছে।

ভোট ময়দানে কার সঙ্গে কার তলে তলে সমঝোতা হল, তার কোনও প্রমাণ কারও হাতেই থাকে না। দলগুলি অনুমান এবং পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে নিজেদের স্বার্থে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিকে আঙুল তোলে মাত্র। এ রাজ্যে কংগ্রেসের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। এবং সেই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, “সিপিএমের নিজেদের অবস্থা খারাপ। বাংলা থেকে এ বার মুছে যাবে বুঝে তারা এ সব অদ্ভুত কথা বলছে!”

কিন্তু কংগ্রেসের একাংশই বলছে, কলকাতা লাগোয়া দমদম, বারাসত, হাওড়া, দক্ষিণবঙ্গে হুগলি, নদিয়ার কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, বর্ধমানের একাধিক আসন বা বীরভূমের বোলপুর বা পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক এই রকম একাধিক আসনে দলীয় প্রার্থীরা বিশেষ পরিচিত মুখ নন। একে বেশ কিছু জায়গায় প্রার্থীর নাম ঘোষণায় দেরি হওয়ায় অন্য তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রচার শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে কংগ্রেসের, তার উপরে প্রার্থী চেনাতে বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে!

এর পাল্টা বলা হচ্ছে, লোকসভা ভোটে প্রার্থী নয়, প্রতীকই গুরুত্বপূর্ণ। প্রার্থীর ব্যক্তিগত পরিচিতি এখানে ততটা ছাপ ফেলে না, যতটা ফেলে দলের নীতি। কিন্তু তার পরেও ওজনদার প্রার্থী যে খানিকটা বাড়তি সুবিধা পেয়ে যান, সেটা অস্বীকারের উপায় নেই। ঠিক যেমনটা পাচ্ছেন আলিপুরদুয়ারে জোসেফ মুণ্ডা, জলপাইগুড়িতে সুখবিলাস বর্মা, পুরুলিয়ায় নেপাল মাহাতো, ঘাটালে মানস ভুঁইয়ার মতো কংগ্রেস প্রার্থীরা। প্রতিদ্বন্দ্বীদের চিন্তায় রাখছেন তাঁরা। কংগ্রেসেরই এক নেতার আক্ষেপ, “তৃণমূলের সঙ্গে বারবার জোট হয়ে এমনিতেই দক্ষিণবঙ্গে কংগ্রেসের সংগঠন দুর্বল হয়েছে। প্রার্থী বাছাই ঠিক হলে তার মধ্যেও ভাল লড়াই করার সুযোগ তৈরি হতো। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা হয়নি।”

প্রদেশ কংগ্রেসের একাংশ বলছেন, পরিচিত নেতাদের প্রার্থী হওয়া নিয়ে জটিলতা এই পরিস্থিতির জন্য অনেকটা দায়ী। একক ভাবে লড়াই জোরদার করার জন্য অধীরের মতোই দলের সহ-সভাপতি রাহুলও চেয়েছিলেন, কংগ্রেসের সব পরিচিত নেতাই ভোটে লড়ুন। প্রথমে দাঁড়াতে না-চাওয়া, তার পরে রাজি হওয়া, বেশ কিছু নেতার এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলাচলে সময় বেরিয়ে গিয়েছে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরিচিত নেতা শেষ পর্যন্ত নারাজ থাকায় অপরিচিত মুখকে টিকিট দিতে হয়েছে। কিন্তু দলের ভিতরের জটিলতাই এর জন্য দায়ী, নাকি তলে তলে আরও কিছু কারণ আছে, সেই প্রশ্নও উঠছে।

কংগ্রেস সূত্রের বক্তব্য, জেলা স্তর থেকে মতামত নিয়ে প্রদেশ নির্বাচনী কমিটি যখন প্রার্থী তালিকা তৈরি করেছে, তখনই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বদল হল। নতুন সভাপতি এসে একটি তালিকা তৈরি করে দিল্লিতে পাঠালেন। সেখানে আবার সমস্যা হল। ওই নেতার কথায়, “বেশ কিছু দিন ধরে দলের আইনজীবী নেতা অরুণাভ ঘোষকে বারাসতে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত হতে বলা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, তাঁকে দমদমে দাঁড়াতে বলা হচ্ছে। তিনি শেষ পর্যন্ত দাঁড়ালেনই না!” প্রদেশ নেতৃত্বের একাংশের বক্তব্য, বারাসত থেকে শেষমেশ প্রার্থী করা হয়েছে নতুন সভাপতির সচিবের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ঋজু ঘোষালকে। আবার বারাসতে মনোনয়ন না-পেয়ে অরুণাভবাবু বেঁকে বসায় দমদমেও স্বল্প-পরিচিত মুখ ধনঞ্জয় মৈত্রকে আনতে হয়েছে।

নদিয়ার জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর সিংহ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষককে (মুসলিম) কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন। সেই নাম প্রদেশ নির্বাচন কমিটি প্রাথমিক ভাবে অনুমোদনও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এআইসিসি-র কাছে পাঠানো হয় রাজিয়া আহমেদের নাম। যিনি এর আগে পুরভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। দলেও সে ভাবে চেনামুখ নন। প্রথম দিকে শঙ্করবাবু ভোটের প্রচার থেকে বিরত ছিলেন। পরে অবশ্য প্রচারে সামিল হয়েছেন। যদিও প্রচারের হাল দেখে নদিয়ায় গিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং প্রদেশ সভাপতি। হুগলিতেও যাঁর নামে আপত্তি করে শ্রীরামপুরের প্রার্থী আব্দুল মান্নান রাজনৈতিক সন্ন্যাস নেওয়ার পর্যন্ত হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, তাঁকেই টিকিট দিয়েছে কংগ্রেস।

বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে বিপিন ভোরাকে প্রার্থী করা নিয়ে আপত্তি ছিল কংগ্রেসে। তিনি মূলত তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসকে অস্বস্তিতে ফেলে পারিবারিক কারণ দেখিয়ে তিনি সরেও দাঁড়িয়েছেন। মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ার পরে প্রদীপ অগস্তির নাম প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেও অস্বস্তি মেটেনি। স্থানীয় কংগ্রেসেরই একাংশের দাবি, প্রদীপবাবু কখনওই দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। দলীয় কর্মসূচিতেও তাঁকে দেখা যায়নি।

আবার, বালুরঘাটে ওমপ্রকাশ মিশ্র প্রার্থী হবেন বলে আগের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য ও এ রাজ্যে এআইসিসির পর্যবেক্ষক শাকিল আহমেদ খান জানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রথম দফায় ১৭টি নাম ঘোষণার সময় অযথা বালুরঘাট বাদ রেখে জটিলতা তৈরি করা হয়েছিল। নাম ঘোষণার আগেই প্রচারে নেমে পড়েছিলেন ওমপ্রকাশ। অবস্থা বেগতিক বুঝে তিনি নিজে সনিয়াকে বিষয়টি জানানোয় তাঁর বালুরঘাটে প্রার্থী হওয়া নিশ্চিত হয় বলে কংগ্রেস সূত্রের খবর। দলের এক নেতার কথায়, “বালুরঘাটে ওমপ্রকাশকে প্রথম দিকে ঝুলিয়ে রেখে আমাদের বিরোধীদের কিছুটা সুবিধা করে দে

দলের অন্দরের এই অসন্তোষকে অবশ্য ‘অতীতের কথা’ বলে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ প্রদেশ সভাপতি। অধীরের কথায়, “আগে হয়তো কেউ কেউ কিছু বলছিলেন। এখন তাঁরা কিছু বলছেন কি? সবাই তো দলের হয়ে কাজে নেমেছেন!” অধীর-ঘনিষ্ঠ এক নেতার বক্তব্য, “রাজ্যে ৪২টা আসনে কংগ্রেস যে প্রার্থী দিতে পেরেছে, এটাই বড় কথা!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

congress lok sabha election election candidate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE