Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

পরিবর্তনের বঙ্গেও বিধি বাম বিদেশি লগ্নির

ক্ষমতার রং লাল থেকে সবুজ হয়েছে। ক্ষমতার ভরকেন্দ্র মহাকরণ থেকে সরে এখন নবান্ন। কিন্তু ঘোর ‘পরিবর্তন’-এর এই সময়েও এ রাজ্যে বদলায়নি বিদেশি লগ্নির ভাগ্য। গত দু’বছরে অন্ধকার বরং আরও গাঢ় হয়েছে সেই ক্ষেত্রে। হতাশ শিল্পমহল তাই বলছে, পশ্চিমবঙ্গে শাসকের মসনদে যে-ই বসুক, বিদেশি লগ্নির বিধি যেন বামই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৬
Share: Save:

ক্ষমতার রং লাল থেকে সবুজ হয়েছে। ক্ষমতার ভরকেন্দ্র মহাকরণ থেকে সরে এখন নবান্ন। কিন্তু ঘোর ‘পরিবর্তন’-এর এই সময়েও এ রাজ্যে বদলায়নি বিদেশি লগ্নির ভাগ্য। গত দু’বছরে অন্ধকার বরং আরও গাঢ় হয়েছে সেই ক্ষেত্রে। হতাশ শিল্পমহল তাই বলছে, পশ্চিমবঙ্গে শাসকের মসনদে যে-ই বসুক, বিদেশি লগ্নির বিধি যেন বামই।

কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের তথ্য (সঙ্গের তালিকা দেখুন) অনুযায়ী, ভারতে যা বিদেশি লগ্নি আসছে, তার সিংহভাগই নিয়ে চলে যাচ্ছে মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, গুজরাতের মতো রাজ্যে। অনেক পিছনে পড়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। আগের বাম জমানার মতোই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজ্যে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তুলে ধরতে জানুয়ারিতেই রাজসূয় যজ্ঞ আয়োজন করছে। বিদেশি লগ্নির খোঁজে সিঙ্গাপুর ঘুরে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শিল্পমন্ত্রী ফিকি-র প্রাক্তন মহাসচিব। অথচ সেখানে বিদেশি লগ্নি প্রায় তলানিতে।

শিল্পমহলের বক্তব্য, রাজ্যের অনড় জমি-নীতি, মান্ধাতা আমলের জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন, বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের (সেজ) বিরোধিতা, সিন্ডিকেট, তোলাবাজি ইত্যাদি কারণে দেশীয় বড় শিল্পই রাজ্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ আর আসবে কী ভাবে?

বাণিজ্য মন্ত্রকের তথ্য থেকেই স্পষ্ট যে, বিদেশি লগ্নি টানার ক্ষেত্রে রাজ্যের এই পিছিয়ে পড়া আজ নতুন নয়। ২০০০ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে যেখানে প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা বিদেশি লগ্নি এসেছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে তা ১৪ হাজার কোটিও ছোঁয়নি! ফলে এমন নয় যে, জমানা বদলের পরেই এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে রাজ্য।

কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ব্যর্থতার জন্য মমতা-সরকারের দিকে এখন আঙুল তুলছে শিল্পমহল। দুষছেন অর্থনীতিবিদরাও। তাঁদের প্রশ্ন, দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসন ঘুচিয়ে মসনদে বসার সময় মমতা যে বিপুল আশা সঞ্চার করেছিলেন, তা তিনি এ ভাবে হেলায় হারালেন কেন?

কেন এত দিন পরেও শিল্প কোথা থেকে এক লপ্তে বড় জমি পাবে, তা স্পষ্ট করা গেল না? কেন সেজ নিয়ে ছুঁতমার্গের কারণে ক্যাম্পাস গড়তে আগ্রহ দেখিয়েও পিছিয়ে গেল ইনফোসিস? কেন সরকারের চাপের মুখে জমি ফেরাতে হল জিন্দলদের? কেন সরকারি বেঞ্চে বসেও মোছা গেল না সিঙ্গুর-আন্দোলনের জঙ্গি ভাবমূর্তি? শিল্পমহলের প্রশ্ন, এখানে টাকা ঢালতে গিয়ে দেশি সংস্থাগুলিরই যদি এই অবস্থা হয়, তবে ভরসা করে টাকা ঢালবে কোন বিদেশি লগ্নিকারী?

সেই ভরসা যে অর্জন করা যায়নি, তা স্পষ্ট সরকারি পরিসংখ্যানেই। ২০১২-’১৩ বা ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে বিদেশি লগ্নি আসার ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র, দিল্লি, গুজরাত, কর্নাটক, তামিলনাড়ুর পাশে রীতিমতো বামন দেখাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গকে। চলতি অর্থবর্ষে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘ফার্স্ট বয়’ মহারাষ্ট্র যেখানে ১৫ হাজার কোটির বিনিয়োগ টেনেছে, সেখানে রাজ্যে এসেছে ৫৮৯ কোটি টাকা!

বিশেষজ্ঞরা সকলেই বলছেন, লগ্নি (বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগ) আসার ক্ষেত্রে একটা বড় শর্ত রাজ্যের ভাবমূর্তি। বামেদের কথায়-কথায় ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলন এবং বিদেশি লগ্নির বিরোধিতার জন্য এমনিতেই তা কোনও দিন ভাল ছিল না। আর রাজ্যের নতুন সরকারের জমানায় শোধরানো তো দূর অস্ৎ, বরং আরও কয়েক পোচ কালি লেগেছে তাতে। তাঁদের মতে, রাজ্যের ভাবমূর্তিকে ঝেড়েমুছে সাফ করতে যে দূরদৃষ্টি বা চেষ্টার প্রয়োজন ছিল, তার কোনওটাই দেখিয়ে উঠতে পারেনি তৃণমূল-সরকার। নজর দেওয়া হয়নি প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণে। বরং উল্টে সিন্ডিকেট ও তোলাবাজির সমস্যা মাথাচাড়া দিয়েছে। বহু ব্র্যান্ডের পণ্যের খুচরো ব্যবসা (রিটেল) থেকে বিমা প্রায় সব ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের দরজা ফাঁক করার বিরুদ্ধে সংসদে রুখে দাঁড়াচ্ছে তৃণমূল। সারদা-কাণ্ডের কালি ছিটছে নেতা-মন্ত্রীদের গায়ে। আর এই সমস্ত কারণেই এই সরকারের মানসিকতা ও নীতি নির্ধারণের পন্থাকে কাঠগড়ায় তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে রাজ্য সপ্তম স্থানে রয়েছে ঠিকই। কিন্তু প্রথম ছয় রাজ্যের সঙ্গে ব্যবধান সেখানে আকাশ-পাতাল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি বিদেশি লগ্নি যেটুকু এসেছে, তা মূলত তথ্যপ্রযুক্তি, পরিষেবা এবং বিভিন্ন যৌথ উদ্যোগে। শিল্পমহলের প্রশ্ন, কল-কারখানাই যদি না হয়, তবে বড় অঙ্কের বিদেশি বিনিয়োগ আসবে কোথায়?

বিদেশি লগ্নি সে ভাবে আসেওনি। বরং তৃণমূল নেতাদের জুলুমে হলদিয়া থেকে পাততাড়ি গুটোতে বাধ্য হয়েছে এবিজি। এবং সেই প্রসঙ্গে ফরাসি রাষ্ট্রদূত ফ্রাঁসোয়া রিশিয়ের কলকাতায় বলেছেন, ওই ঘটনা রাজ্য সম্পর্কে ভাল বার্তা দেয় না।

আইআইটি-খড়গপুরের অর্থনীতির অধ্যাপিকা বাণী চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “সবটাই নির্ভর করে রাজ্য সরকারের নীতির উপর। তারা কতখানি নাক গলাচ্ছে, শিল্পপতিদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে কি না, পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রশাসন কতটা নমনীয় এই সবই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেখেন। মাথাপিছু আয়, শিক্ষার মান ইত্যাদি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজ্যে সড়ক, যোগাযোগ-ব্যবস্থার মতো পরিকাঠামো কতটা ভাল, তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে।”

বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোথাও টাকা ঢালার আগে দেখতে চান, সেখানে তা কতটা স্বাগত। মাপেন, কতখানি সুরক্ষিত তাদের লগ্নি। অথচ সেখানে বাম এবং তৃণমূল দুই দলই বিদেশি লগ্নির বিরোধিতায় প্রায় সব সময় একপায়ে খাড়া। আগে সিপিএম নেতারা বিদেশি লগ্নির নাম শুনলেই লাল ঝাণ্ডা হাতে রাস্তায় নামতেন। আর এখন হরবখত তার বিরোধিতা করেন তৃণমূল নেতৃত্ব।

রিটেলে বিদেশি লগ্নির বিরোধিতা করে ইউপিএ-সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিলেন মমতা। এখন মোদী জমানায় সংসদে গলা মিলিয়ে বিমায় বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানোর বিরোধিতা করছে বাম-তৃণমূল। বণিকসভার এক কর্তার বক্তব্য, “রাজ্যে বড় কারখানার জন্য জমি পাওয়া শক্ত। রাজ্য সরকার যে জমি-ব্যাঙ্কের কথা বলে, সেখানে বড় কারখানা হয় না। একমাত্র খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি আসার সুযোগ ছিল। সেখানেও নো এন্ট্রি।”

বিদেশি লগ্নির এই গেরো কাটাতে বাণীদেবীর দাওয়াই, “রাজ্যকে আরও উদার নীতি নিতে হবে। তৈরি করতে হবে ভাল পরিকাঠামো। হতে হবে ইতিবাচক ও বাস্তববাদী।” রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নথিও বলছে, পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলিকে বিদেশি লগ্নিকারীদের সামনে আরও আকষর্র্ণীয় করে তুলতে হবে। তার জন্য কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলতে হবে রাজ্যকে।

কিন্তু রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে সেই বার্তা শোনার ইঙ্গিত কই?

তৃণমূল নেতা সৌগত রায়ের কথায়, “প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি (এফডিআই) একটা ভাঁওতা। কোনও ক্ষেত্রেই বিদেশি লগ্নি আমরা চাই না। তবে বিদেশি সংস্থা কারখানা তৈরি করলে, আপত্তি নেই!” সিপিএম আবার এ ক্ষেত্রে দুষছে মমতার সরকারকে। সিপিএম নেতা নীলোৎপল বসু বলেন, “বিদেশি লগ্নি এলে যদি উৎপাদন বাড়ে, ছাঁটাই না-হয়, তা হলে আপত্তি নেই। বাম জমানার শেষ দশ বছরে বিদেশি লগ্নি আসার ছবি মোটেই খারাপ ছিল না। মমতার আমলেই বরং সকলে মুখ ফেরাচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nabanna foreign investment westbengal government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE