Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাড়ি থেকে পালিয়ে ঠাঁই হোমে, আজ বাংলাদেশে ফিরছে রাকিবুল

মাদ্রাসার ঘেরাটোপে মন টিঁকত না ছেলেটার। দু’চোখে তার অনেক স্বপ্ন। সাতপাঁচ ভেবে এক দিন পালাল সব গণ্ডি ছেড়ে। বাবা-মায়ের স্নেহ, বাংলাদেশের গাঁয়ের বাড়ির আলো-হাওয়া, খেলার মাঠ, সঙ্গীসাথী— কোনও পিছুটানই বাঁধতে পারেনি তাকে। এখান ওখান ঘুরে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ে হাওড়ায়। ঠাঁই মেলে হোমে। আজ, মঙ্গলবার বছর ষোলোর কিশোর রাকিবুল হাসানকে ফেরত পাঠানো হবে বাংলাদেশে, তার বাড়িতে।

হোমের সঙ্গীদের ছেড়ে এ বার ঘরে ফেরার পালা। ছবি: সুব্রত জানা।

হোমের সঙ্গীদের ছেড়ে এ বার ঘরে ফেরার পালা। ছবি: সুব্রত জানা।

নুরুল আবসার
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৪ ০৩:৩৭
Share: Save:

মাদ্রাসার ঘেরাটোপে মন টিঁকত না ছেলেটার। দু’চোখে তার অনেক স্বপ্ন।

সাতপাঁচ ভেবে এক দিন পালাল সব গণ্ডি ছেড়ে। বাবা-মায়ের স্নেহ, বাংলাদেশের গাঁয়ের বাড়ির আলো-হাওয়া, খেলার মাঠ, সঙ্গীসাথী— কোনও পিছুটানই বাঁধতে পারেনি তাকে। এখান ওখান ঘুরে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ে হাওড়ায়। ঠাঁই মেলে হোমে। আজ, মঙ্গলবার বছর ষোলোর কিশোর রাকিবুল হাসানকে ফেরত পাঠানো হবে বাংলাদেশে, তার বাড়িতে। হরিদাসপুর সীমান্তে তাকে বিডিআর-এর হাতে প্রত্যর্পণ করার কথা। তিন বছর ধরে ছেলের পথ চেয়ে চোখের পানি ফেলে নিশ্চিন্ত রাকিবুলের বাবা-মা। ঘরের ছেলেকে ফেরাতে সীমান্তে থাকবেন তাঁরাও।

রাকিবুলের বাড়ি বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর থানার খামারগ্রামে। ২০১১ সালের মার্চ মাসে তেরো বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিল সে। কিশোরটি জানায়, জলপাইগুড়ি, রানিনগর, বানারহাট, মালদা হয়ে চলে আসে কলকাতায়। এত বড় শহর দেখে চোখ ছানাবড়া। কত লোক, বিশাল বিশাল বাড়ি, কত্ত মোটর গাড়ি...। কিন্তু সেখানেও মন টেঁকেনি ছেলেটার। ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে হাওড়ায়। দাশনগর থেকে ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ পুলিশ তাকে ধরে হাওড়া জেলা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির হাতে তুলে দেয়। কমিটি তাকে পাঁচলার মালিপুকুরে বেসরকারি হোমে পাঠায়।

শুধু দেশ-বিদেশ ঘুরলেই তো পেট চলে না। কী করতে খিদে পেলে? রাকিবুল জানায়, ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত প্রায় দু’বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে। আর খিদে পেলে পুরনো খবরের কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে টাকা জোগাড় হয়েছে।

কিন্তু বাড়ির সাধা ভাত ফেলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেও মনে দিব্যি ফূর্তি ছিল রাকিবুলের। কিন্তু হোম কর্তৃপক্ষের নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ে সে বাবার নাম-ঠিকানা জানিয়ে দেয়। বাবা জয়নাল আবেদিনের মোবাইল নম্বর জোগাড় করেন হোম কর্তৃপক্ষ। যোগাযোগও হয় তাঁর সঙ্গে। জয়নাল হোমে এসেছিলেন। ছেলেকে জড়িয়ে ধরলে পারলে তখনই সঙ্গে করে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু সরকারি নিয়ম-কানুন বড় বালাই। পিতার উৎকণ্ঠার মূল্য তার থেকে বেশি নয়। কাজেই কাগজে-কলমে সমস্ত প্রক্রিয়া সারতে কেটে যায় আরও ছ’টা মাস। সমস্ত নথিপত্র ঘেঁটে বাংলাদেশ হাই কমিশন নিশ্চিত হয়, ছেলেটি তাদের দেশেরই নাগরিক। রাকিবুলকে নিজেদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজ্য স্বরাষ্ট্র (বিদেশ) দফতরের কাছে আবেদন জানায় বাংলাদেশ হাইকমিশন। হোম কর্তৃপক্ষকেই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বিডিআর-এর হাতে রাকিবুলকে প্রত্যর্পণের দায়িত্ব দিয়েছে রাজ্য স্বরাষ্ট্র (বিদেশ) দফতর। হাওড়া জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিক দেবকুমার ভট্টাচার্য বলেন, “বিভিন্ন হোমে আরও বাংলাদেশি নাবালক রয়েছে। বাবা-মায়েরা আগ্রহ দেখালে তাদেরও নিজেদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব।”

কেন সে পালিয়ে এল বাড়ি থেকে? এই প্রশ্নের উত্তরে রাকিবুল বলে, “মাদ্রাসায় পড়তাম। সেখানকার বদ্ধ জীবন ভাল লাগত না। তাই পালিয়ে আসি।” অন্য দিকে বাংলাদেশ থেকে ফোনে জয়নাল বলেন, “দু’বছর ধরে ছেলেকে খুঁজেছি। থানায় ডায়েরি করেছি। ছেলেটাকে বাড়ি না আনা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না।” রাকিবুলকে শেষমেশ দেশে ফেরানোর বন্দোবস্ত করতে পেরে উচ্ছ্বসিত হোমের কর্ণধার অপর্ণা চক্রবর্তী। বললেন, “আমি নিজে রাকিবুলকে তার বাবার হাতে তুলে দেব। খুবই আনন্দ পাচ্ছি।”

কৈশোরেই যে ছেলের পায়ের তলায় সর্ষে নড়ে উঠেছে, তাকে ক’দিন ধরে রাখা যাবে, তা নিয়ে এখনও উদ্বেগে রাকিবুলের বাবা-মা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nurul absar rakibul home
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE