তারা ছিল প্রায় যমজ সহোদরের মতো! প্রায় অবিশ্বাস্য বিচ্ছেদ এ বারের বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে। দীর্ঘ দিনের সঙ্গী শিবসেনার হাত শেষ মুহূর্তে ছেড়েও মহারাষ্ট্রে ১২২টি আসন পেয়ে কুর্সিতে পৌঁছেছে বিজেপি। চমকপ্রদ এই সাফল্যের মধ্যেও আরর সাগরের তীরে বিজেপি ভোট পেয়েছে কত? মাত্রই ২৭.০৮%!
তুলনায় কম ভোট পেয়েও বহুমুখী লড়াইয়ের ময়দানে শেষ হাসি হাসতে পারার এই মহারাষ্ট্র মডেলই এখন ছায়া ফেলতে শুরু করেছে বঙ্গ রাজনীতিতে। আসন-সংখ্যার নিরিখে মহারাষ্ট্রের সঙ্গে অনেকটা মিল পশ্চিমবঙ্গের। মরাঠা তালুকে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ১৪৫টি আসন দরকার, এ রাজ্যে প্রয়োজন ১৪৮টি। বঙ্গ বিজেপি স্বাভাবিক ভাবেই মনে করছে, সর্বত্র সমান সাংগঠনিক বল না থেকেও একক শক্তিতে বড় রাজ্যের মসনদ যে ছুঁয়ে ফেলা সম্ভব, স্পষ্ট ভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে মহারাষ্ট্র। কিন্তু এই মরাঠা মডেলই একই সঙ্গে বিজেপি-র জন্য এখন স্বস্তি এবং অস্বস্তির কারণ!
কী ভাবে? জোট বেঁধে লড়ে পাঁচ বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে বিজেপি পেয়েছিল ১৪% ভোট। সেখানে এ বার একা লড়ে প্রায় ২৮%। অর্থাৎ বৃদ্ধি দ্বিগুণ! বঙ্গের বিজেপি-ও সাড়ে তিন বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনে যেখানে প্রায় ৬.৫% ভোট পেয়েছিল, সেখান থেকে এ বারের লোকসভা ভোটে তারা উঠে এসেছে ১৭%-এ। বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, শাসক দল ভোট লুঠ না করলে এই ভোট-প্রাপ্তির হার তাঁদের আরও বাড়ত। মহারাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত দেখার পরে এখন তাঁরা স্বপ্ন দেখছেন, ২০১৬-র বিধানসভায় তা হলে এই ভোটকে আরও ৮-১০% বাড়ানো সম্ভব এবং সেটা হলে ক্ষমতার সিংহাসনে পৌঁছে যাওয়াও অসম্ভব নয়!
দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “এ রাজ্যে কংগ্রেস এখন কিছু জেলার কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে রয়েছে। সিপিএমের ভোট যে আরও কমবে, বসিরহাটের উপনির্বাচন থেকেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। বিধানসভা ভোটে বিজেপি-কেই বিকল্প বলে মনে করবেন মানুষ।”
বিকল্প হয়ে ওঠার দৌড়ে রাজ্য বিজেপি-র স্বস্তি আরও বাড়াচ্ছে মহারাষ্ট্রই। কারণ, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় তাঁদের পরীক্ষা সফল হওয়ার পরে বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘একলা চলো’ই এখন গেরুয়া শিবিরের নীতি। এর পরে ২০১৫-য় বিহার এবং ২০১৬-য় পশ্চিমবঙ্গে যে হেতু ভোট, তাই পূর্বাঞ্চলেই এখন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের নজর বেশি পড়বে। দর কষাকষির রাজনীতি করতে করতে কোনও এক সময় তৃণমূল কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলতে পারে, এই জল্পনারও মহারাষ্ট্রের ভোটের পরে ইতি পড়ে গেল বলে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের অভিমত। এবং এই স্বস্তি থেকেই তাঁরা ‘মিশন ২০১৬’র জন্য ঝাঁপাচ্ছেন।
তা হলে অস্বস্তি কোথায়? সেই ধাঁধাও লুকিয়ে মহারাষ্ট্রের ভোটের অঙ্কেই! যে অঙ্ক বলছে, প্রতিদ্বন্দ্বীরা যদি বিভক্ত হয়, তা হলে তুলনায় অনেক কম ভোট পেয়েও এক নম্বরে শেষ করা সম্ভব! লোকসভা ভোটে ঠিক এই ভাবেই ৩৯% ভোট পেয়েও বাংলায় ৩৪টি আসন জিততে পেরেছিল তৃণমূল। মহারাষ্ট্রের উদাহরণ দেখার পরে এ বার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে আরও বেশি করে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা অংশের জন্য অনুদান-নির্ভর রাজনীতি শুরু করবেন বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। ভোট ভাগাভাগি হয়ে তৃণমূলের সুবিধা হয়ে যাওয়ার ভাবনাই চিন্তার ভাঁজ রেখে দিচ্ছে গেরুয়া শিবিরে।
ঠিক এই জায়গা থেকেই সঙ্কট কাটিয়ে উত্তরণের আশা দেখছে তৃণমূল শিবির। তাদের অঙ্ক, রাজ্যের প্রায় ২৮% সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগই এখন নিজের কব্জায় রেখেছেন মমতা। বিজেপি-র তৎপরতা যত বাড়বে (বিশেষ করে বর্ধমান-কাণ্ডের পরে), সংখ্যালঘু ভোটকে নিজের দিকে সংহত করতে আরও সুবিধা হবে মমতার। এর সঙ্গে আরও ৮-১০% ভোট টানতে পারলেই অধিকাংশ আসনে কেল্লা ফতে হবে তৃণমূলের! দলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, “মহারাষ্ট্র আর পশ্চিমবঙ্গ এক নয়। এ রাজ্যের সব অংশের মানুষের কাছে পৌঁছনো বিজেপি-র পক্ষে এত সহজ নয়!” রাজ্য বিজেপি-র এক শীর্ষ নেতার আবার পাল্টা দাবি, “সচেতন সংখ্যালঘু মানুষ কিন্তু তৃণমূলের রূপ বুঝতে পারছেন। বীরভূমে সম্প্রতি আমাদের যে দু’জন খুন হয়েছেন তৃণমূলের হাতে, তাঁরা সংখ্যালঘুই।”
তবে একই সঙ্গে শাসক দলের ওই শীর্ষ নেতা অবশ্য মানছেন, “মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা, দুই রাজ্যেই মানুষ অনেক দিন বিজেপি-কে সরকারে দেখেননি। সেই জায়গা থেকে তাঁরা বিজেপি-র দিকে ঝুঁকেছেন। এ রাজ্যে যে হেতু বিজেপি-কে কোনও দিনই ক্ষমতায় দেখেননি মানুষ, তাই তাদের পরীক্ষা করতে চাওয়ার একটা দিক থেকে যাচ্ছে।”
সংখ্যালঘু এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভোটকে পুরোপুরি নিজেদের দিকে টানার তাগিদে আগামী বছর পুরভোটের সময়েই কংগ্রেসকে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন তৃণমূল নেত্রী, এমন জল্পনাও এখন থেকে গতি পাচ্ছে। যদিও প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখার লড়াইয়ে তৃণমূল না বাম, কাদের সঙ্গে সমঝোতা করা উচিত, সেই প্রশ্নে বিতর্ক রয়েছে কংগ্রেস শিবিরে। সিপিএম আবার এখন বৃহত্তর বাম ঐক্যের পথে যেতে চাইছে বামফ্রন্টের বাইরের দলগুলিকে পাশে নিয়ে, যাদের মধ্যে কংগ্রেস-প্রশ্নে তীব্র আপত্তি! বামেরা কংগ্রেস থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকলে আখেরে মমতারই লাভ! তবে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, “বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যে এবং কেন্দ্রে কত ঘটনা ঘটবে! পথ এখনও অনেক বাকি!”
সেই পথেই আপাতত টানটান উত্তেজনা! ‘মিশন ২০১৬’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy