এ বার আর ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বেলপাহাড়ি কিংবা অযোধ্যা পাহাড় নয়। খাস লালগড়েই সশস্ত্র মাওবাদীদের আনাগোনার নির্দিষ্ট খবর পেয়েছেন গোয়েন্দারা। জনসাধারণের কমিটি প্রতিষ্ঠার ছ’বছর পূর্তির মুখে!
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র দাবি, রাজ্যের কয়েক জন শীর্ষ মাওবাদী নেতা সম্প্রতি লালগড়ে যেখানে মিটিং করেছেন, তার নাম বোমা খাড়াং। বড় গর্তকে খাড়াং বলেন জঙ্গলমহলের মানুষের একাংশ। বোমা খাড়াং-এর অবস্থান লালগড়ের উত্তর-পূর্ব কোণে মেলখেড়িয়ার জঙ্গলে। কথিত আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমারু বিমান থেকে ফেলা বোমায় তৈরি হয় ওই বিশাল গর্ত। যেন প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি বাঙ্কার। ঢুকলে সহজে কারও নজরে পড়ে না। ক্যানাল পেরিয়ে পৌঁছতে হয় সেখানে। যৌথ বাহিনী টহল দেয় কালেভদ্রে।
আইবি সূত্রেরই খবর, এক সপ্তাহ আগে লালগড়ের এসআই চক ও ঠাকুরপাড়া গ্রামের মধ্যবর্তী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তিন সশস্ত্র মাওবাদী বড় রাস্তা পেরোনোর সময়ে দুই গ্রামবাসীর চোখে পড়ে যায়। লালগড়ে সিআরপি-র গোয়েন্দাদের একাংশও ওই খবরের সত্যতা স্বীকার করে নেন। দহিজুড়ি থেকে কংসাবতী পেরিয়ে বামাল হয়ে জঙ্গলপথে পূর্ণাপানি যাওয়ার পুরনো পথ নতুন করে ব্যবহার করছে মাওবাদীরা। তা ছাড়া, সপ্তাহ দুয়েক আগে এক বৃষ্টির রাতে সিজুয়ায় মোরাম রাস্তায় ল্যান্ডমাইন পোঁতারও চেষ্টা করেছিল মাওবাদীরা। স্থানীয় কয়েক জনকে দেখে তারা অবশ্য পালায়। লালগড়ের পূর্বে পডিহা গ্রামের গা ঘেঁষা জঙ্গল ও এবং পূর্ণাপানি ও লক্ষ্মণপুর গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলেও গোয়েন্দারা খোঁজ পেয়েছেন এমন বাঙ্কারের, যাতে ঢুকলে কর্পূরের মতো উবে যাওয়া সহজ। এই সব এলাকায় সশস্ত্র মাওবাদীদের তৎপরতা নতুন করে ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের।
বৃহস্পতিবার লালগড়ে মাওবাদীদের হাতে তৈরি গণসংগঠন পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটির ছ’বছর পূর্ণ হচ্ছে। ২০০৮-এর ১৩ নভেম্বর লালগড়ের দলিলপুর চকে ওই কমিটি গঠিত হয়। পর দিন লালগড় থানায় পশ্চিম মেদিনীপুরের তদানীন্তন অতিরিক্ত জেলাশাসক অ্যারন ইসরায়েলের সঙ্গে বৈঠকে ১১ দফা দাবি সনদ পেশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে কমিটি। যার আন্দোলনকে সামনে রেখে, বিস্তীর্ণ এলাকায় পুলিশের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে তল্লাটের পর তল্লাট দখলে নিয়েছিল মাওবাদীরা।
সেই কমিটি এখন আর নেই। ছত্রধর মাহাতো, সুখশান্তি বাস্কের মতো কমিটির নেতারা এখন জেলে। দিলীপ মাহাতো, শ্যামল মাহাতোর মতো নেতারা তৃণমূলে। মাওবাদী কার্যকলাপ নেই। উত্তাল আন্দোলন শুরু হওয়ার পরিস্থিতিও নেই লালগড়ে। তা হলে মাওবাদীদের নিঃশব্দ যাতায়াতে কেন উদ্বেগে গোয়েন্দারা? আইবি-র বক্তব্য, কমিটি না থাকলেও বোমা খাড়াং-এ আকাশ ও বিকাশের ডাকা গোপন সভায় শতাধিক মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। আইবি-র মতে, কয়েকটি অঞ্চলে পঞ্চায়েত স্তরে দুর্নীতির কারণে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। আর সে কথা জেনেই মাওবাদীরা জল মাপতে আসছে এবং পুরনো লিঙ্কম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আইবি-র এক অফিসারের কথায়, “কমিটির সবাই মন থেকে তৃণমূল হয়নি। অনেকেই শাসক দলে ঝুঁকেছে যখন-তখন মামলায় ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে।” সিজুয়া গ্রামের কিঙ্কর সিংহ যেমন বলেন, “আপাতত তৃণমূল সমর্থক হিসেবেই আছি।” এক সময়ে গ্রামে গ্রামে কমিটির শাখা তৈরির দায়িত্বে ছিলেন কিঙ্কর।
গোয়েন্দাদের দুশ্চিন্তা বেড়েছে অন্য একটি খবরে। লালগড়ের ডাইনটিকরি গ্রামের এক যুবকের হাতে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র গচ্ছিত রেখেছিল মাওবাদীরা। সম্প্রতি তিনি পুলিশের কাছে বন্দুকগুলি জমা দেবেন বলে তোড়জোড় করেন। কিন্তু জানতে পেরে হাঁ হাঁ করে ওঠেন জনসাধারণের কমিটির এক প্রাক্তন শীর্ষনেতা, যাঁর বাড়ি দ্বারিগেড়িয়া গ্রামে। যিনি, পুলিশের দাবি, ফেরার। কমিটির প্রাক্তন ওই নেতা অস্ত্র সমর্পণে ইচ্ছুক যুবককে বলেন, “এখন ওগুলো যেমন আছে, তেমনই থাকুক। কিছু দিনের মধ্যেই ফের কাজে লাগতে পারে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy