Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

শিক্ষার অঙ্গনে হাঙ্গামা কমই দেখছেন পার্থ

ফেসবুকে মন্তব্য করে কখনও ছাত্রছাত্রীদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে শিক্ষককে! কোনও কোনও কলেজে আবার ছাত্র সংসদের নির্বাচন ঘিরে রণক্ষেত্র হয়ে উঠছে শিক্ষাপ্রাঙ্গণ!! কলেজ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র তোলাকে কেন্দ্র করে গোলমালে খুন হয়ে যাচ্ছেন পুলিশ অফিসার!!! এ-সব সত্ত্বেও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, বাম আমলের তুলনায় বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্রে গোলমাল ৬০ শতাংশ কমে গিয়েছে!

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:০০
Share: Save:

• ফেসবুকে মন্তব্য করে কখনও ছাত্রছাত্রীদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে শিক্ষককে!

• কোনও কোনও কলেজে আবার ছাত্র সংসদের নির্বাচন ঘিরে রণক্ষেত্র হয়ে উঠছে শিক্ষাপ্রাঙ্গণ!!

• কলেজ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র তোলাকে কেন্দ্র করে গোলমালে খুন হয়ে যাচ্ছেন পুলিশ অফিসার!!!

এ-সব সত্ত্বেও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, বাম আমলের তুলনায় বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্রে গোলমাল ৬০ শতাংশ কমে গিয়েছে!

রবিবার সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভায় গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোলমাল কমেছে বলে মন্তব্য করেন শিক্ষামন্ত্রী। আর কলেজে লাগাতার হাঙ্গামায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে সেই সমিতিরই বার্ষিক রিপোর্টে! এবং রিপোর্ট পেশ করতে গিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রের অরাজকতায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেন সমিতির সভাপতি দেবাশিস সরকার। তা সত্ত্বেও মন্ত্রীর এমন দাবিতে কলেজ শিক্ষকদের একাংশ বিস্মিত।

ঠিক কী বলেছেন পার্থবাবু?

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে রাজ্যের ৭০০টি কলেজের মধ্যে গোলমাল হয়েছে মাত্র ১৭টিতে।” অনেকে অবশ্য বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার অঙ্গনে গোলমালের পিছনে পার্থবাবুর দল তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি-র জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এ দিন পার্থবাবুর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কলেজ শিক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, গোলমাল কমে যাওয়ার কথা বলে কার্যত নিজের দলের ছাত্র সংগঠনের পাশেই দাঁড়িয়েছেন মন্ত্রী।

শিক্ষকদের একাংশের মতো বাম আমলের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরীও নয়া জমানার শিক্ষামন্ত্রীর দাবিতে বিস্মিত। তিনি বলেন, “উনি (পার্থবাবু) কীসের নিরিখে ৬০ ভাগ গোলমাল কমার কথা বলছেন, বুঝতে পারছি না। আসলে সব ছাত্র সংসদই তো দখল করে বিরোধী-শূন্য করা হয়েছে। তাই শিক্ষকেরা এখন আক্রান্ত হচ্ছেন। উনি হয়তো সেই নিরিখেই গোলমাল কমার কথা বলেছেন!” এই আমলের অরাজকতা অভূতপূর্ব বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তবে পার্থবাবুর দাবি, তিনি তথ্য দিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে অরাজকতা কমে যাওয়ার কথা প্রমাণ করতে পারবেন। তাঁর কথায়, “আমি আশ্বস্ত করে বলতে পারি, গত বারের তুলনায় এ বার অরাজকতার প্রবণতা অন্তত ৬০ ভাগ কমে গিয়েছে। কারণ, আসনে (মন্ত্রীর) বসে আমি অন্যায়কে অন্যায় আর ন্যায়কে ন্যায় হিসেবেই দেখেছি। পতাকার রং দেখিনি, দেখবও না।”

প্রশ্ন উঠেছে, ‘গত বার’ বলতে শিক্ষামন্ত্রী কী বোঝাতে চেয়েছেন? অনেকেই বলছেন, গত মে-তে ব্রাত্য বসুকে সরিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর পদে বসেন পার্থবাবু। ব্রাত্যবাবুর আমলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোলমাল হত। তা হলে কি গত বারের আমল বলতে তিনি ব্রাত্যবাবুর সময়কেই বুঝিয়েছেন?

সভার শেষে পার্থবাবুর জবাব, তিনি ‘গত বার’ বলতে ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে বাম আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রের অরাজকতাকেই বুঝিয়েছেন।

শিক্ষাজগতের অনেকেই বলছেন, মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে পার্থবাবু দলমত নির্বিশেষে সব শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ঠিকই। প্রথম দিকে গোলমালের ক্ষেত্রে নিজের দলের ছাত্র সংগঠনকে সংযত হওয়ার কথাও বলেছিলেন। শাসক দলের অন্দরের খবর, পার্থবাবুর আপত্তিতেই একের পর এক গোলমাল এবং বিতর্কে জড়ানো শঙ্কুদেব পণ্ডাকে টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে অশোক রুদ্রকে বসানো হয়। কিন্তু তার পরেও গোলমালে ছেদ পড়েনি। যার সাম্প্রতিক নিদর্শন ঘাটাল কলেজের শিক্ষক অমিত রায়কে মারধর। ফেসবুকে অমিতবাবুর একটি মন্তব্য টিএমসিপি-র পছন্দ না-হওয়ায় তাঁকে পেটানো হয় বলে অভিযোগ। এ ছাড়াও ক্যান্টিন দখল, অপছন্দের বিভাগীয় প্রধানকে অপসারণ আর ঘেরাও-আন্দোলন লেগেই আছে।

পার্থবাবু অবশ্য এগুলোকে আমল না-দিয়েই এ দিন বলেন, “কোথাও কিছু হলেই সংবাদমাধ্যমে না-গিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলছি। আপনারাও সংবাদপত্রের খবরের উপরে নির্ভর না-করে নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করে দেখুন, পরিবর্তন এসেছে কি না!”

শিক্ষকদের অনেকেই কিন্তু বলছেন, এ রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসেনি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলছেন, “অরাজকতা কত ভাগ কমেছে, তা অঙ্ক কষে কী ভাবে বলা যেতে পারে, জানি না। তবে আমরা আগেও গোলমাল হচ্ছে দেখতাম। এখনও দেখছি।” তাঁর মতে, আগের আমলেও একটি ছাত্র সংগঠন সর্বত্র বিরাজ করত। এখনও তা-ই হচ্ছে। যেখানে গোলমাল হচ্ছে না, সেখানে আরও বড় প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

গোলমালের ঘটনা মোটেই কমেনি বলে মন্তব্য করেছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “শিক্ষামন্ত্রী সম্পূর্ণ ভুল বলছেন। বরং এখন নৃশংসতা মারাত্মক বেড়ে গিয়েছে। সরকার এ-সব ঘটনাকে লঘু করে দেখলে ভুল করবে।”

শিক্ষাবিদেরা যা-ই বলুন, শিক্ষা ক্ষেত্রের অরাজকতা পার্থবাবুকে তেমন আশঙ্কায় ফেলছে না। তবে তিনি এ দিন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন আন্দোলনের অনশনকারীদের নিয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল পড়ুয়া অনশনে বসে উপাচার্যের পদত্যাগ নিশ্চিত করার পরে এখন স্কুল সার্ভিস কমিশন বা এসএসসি-র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষকপদ প্রার্থী কিংবা পার্শ্বশিক্ষক প্রায় সকলেই অনশনে বসছেন। শিক্ষামন্ত্রী এ দিন বলেন, “অনশনের নামে হচ্ছেটা কী! মেধা থাকলে এমনিই চাকরি পাবেন। অনশন করতে হবে না।”

অনশন প্রসঙ্গে শিক্ষকদেরও বিঁধেছেন শিক্ষামন্ত্রী। তাঁর কথায়, “ছাত্রদের পাশে বসে আপনারাও অনশন করছেন, পোস্টার লিখছেন এই দৃশ্য আমাকে ব্যথা দেয়।”

অনশন-আন্দোলন যে তাঁকে উদ্বেগে ফেলেছে, সেই ইঙ্গিত গত সপ্তাহেই দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। আন্দোলনের এই ধারা রুখতে তিনি এগিয়ে আসতে বলেছেন উপাচার্য ও অধ্যক্ষদের। আর এ দিন সরকারি কলেজ শিক্ষকদের উদ্দেশে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের একটা দিশা দেখাতে হবে। তাঁদের বোঝাতে হবে যে, ভাল কাজে পাশে থাকলেও অন্যায়ে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE