Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
২. কুণাল

সারদা-দোষীদের আড়াল করার অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই

ভোটের মরসুমে সারদা মামলার উত্তাপ আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল! মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশ ও প্রশাসন সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের আড়াল করছেন বলে সরাসরি তোপ দাগলেন ধৃত তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ। মঙ্গলবার বিধাননগর আদালতের বাইরে নাটকীয় ভাবে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় রীতিমতো ধস্তাধস্তি করে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করেন কুণাল। সেখানেই তিনি অভিযোগ করেন, “যাঁরা সুদীপ্ত সেনকে চিনতেন, যাঁরা সুদীপ্ত সেনের মিডিয়ার সুবিধা নিতেন, এই মুখ্যমন্ত্রী, এই সরকার, এই পুলিশ তাঁদের আড়াল করছে। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করছে।”

আদালত থেকে বেরোনোর পথে কুণাল। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

আদালত থেকে বেরোনোর পথে কুণাল। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০১
Share: Save:

ভোটের মরসুমে সারদা মামলার উত্তাপ আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল!

মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশ ও প্রশাসন সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের আড়াল করছেন বলে সরাসরি তোপ দাগলেন ধৃত তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ। মঙ্গলবার বিধাননগর আদালতের বাইরে নাটকীয় ভাবে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় রীতিমতো ধস্তাধস্তি করে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করেন কুণাল। সেখানেই তিনি অভিযোগ করেন, “যাঁরা সুদীপ্ত সেনকে চিনতেন, যাঁরা সুদীপ্ত সেনের মিডিয়ার সুবিধা নিতেন, এই মুখ্যমন্ত্রী, এই সরকার, এই পুলিশ তাঁদের আড়াল করছে। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করছে।”

মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি মুকুল রায় এবং রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রও কুণালের তোপ থেকে রক্ষা পাননি। সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে মুকুল রায়কে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে কুণাল এ দিন বলেন, “সিবিআই, ইন্টারপোল তো সব বড় বড় কথা! সৎ সাহস থাকলে আগে দলের মধ্যে তদন্ত কমিশন গড়ুন। অনেকের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। আমার বিরুদ্ধেও তো অভিযোগ রয়েছে। সেগুলোরও তদন্ত হোক।” মদন মিত্রের বিরুদ্ধে কুণালের মন্তব্য, “ওঁকে অনেক আগেই ডাকা উচিত ছিল। ওঁকে গার্ড করে রাখা হয়েছে!”

কুণালের এই সব অভিযোগই অবশ্য তৃণমূলের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “যাঁরা সুযোগসুবিধা নিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী বা সরকার তাঁদের আড়াল করতে চায় না বলেই কুণাল ঘোষের হাজতবাস হচ্ছে। সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি সকলে মিলে মমতা বন্দ্যোপাধায়ের গায়ে কালি ছেটানোর চেষ্টা করছেন। সেই দলে নাম লিখিয়েছেন কুণাল। এটা খুব দুঃখের, পরিতাপের বিষয়।” মুকুল রায় বলেন, “বিচারাধীন বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।” দলে তদন্ত কমিশন গড়ার পরামর্শ প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “দলের ব্যাপার দলেই বলব।” আর পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “ও কি (কুণাল) আমার মাসতুতো ভাই, না সিবিআই ডিরেক্টর যে আমাকে ডেকে পাঠাতে চায়? এক জন অভিযুক্তের কাছ থেকে আমি আইনের কথা শুনব না।”

সারদা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে গত বছর নভেম্বর মাসে রাজ্যসভার সাংসদ কুণালকে গ্রেফতার করে সল্টলেক পুলিশ। গ্রেফতার হওয়ার পরে তিনি দলের কয়েক জন নেতার বিরুদ্ধে সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনেছিলেন। তাঁদের জেরা করলে এই কেলেঙ্কারির অনেক তথ্য জানা যাবে বলেও তিনি দাবি করেছিলেন। এ ব্যাপারে গোপন জবানবন্দি দেবেন বলেও সল্টলেক আদালতে জানিয়েছিলেন কুণাল। আদালত অনুমতি দিলেও অবশ্য শেষ পর্যন্ত আর ওই জবানবন্দি দেননি তিনি। পরে জানিয়েছিলেন, তাঁকে আর কোনও মামলায় জড়ানো হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তাই তিনি জবানবন্দি দেননি।

তবে কোর্ট এবং কোর্টের বাইরে এর আগেও সরব হয়েছেন কুণাল। তাঁর কথা পুলিশ শুনছে না, তাঁকে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না— এই জাতীয় কথা আগেও শোনা গিয়েছে তাঁর মুখে। কিন্তু এমন জোর গলায়, এত চড়া সুরে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর নাম করে তদন্ত প্রভাবিত করার অভিযোগ এমন নাটকীয় ভাবে আনতে দেখা যায়নি তাঁকে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে সারদা মামলার শুনানি চলাকালীন কুণালের আইনজীবী জানান, কুণাল শীর্ষ আদালতে তাঁর বক্তব্য জানাতে চান। সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে লিখিত ভাবে ওই বক্তব্য জানাতে বলে। কুণালের তরফে হলফনামা জমা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাজ্যসভার চেয়ারপার্সন হামিদ আনসারিকেও তিনি একটি চিঠি লিখেছেন বলে জানা গিয়েছে।

এ দিন সারদা সংক্রান্ত তিনটি মামলার সূত্রে সল্টলেক আদালতে হাজিরা দিতে এসেছিলেন কুণাল। ওই মামলায় হাজির ছিলেন সুদীপ্ত সেনও। বেলা ১০টা নাগাদ আদালতে ঢোকার সময়ে কুণাল সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবি তিনি কেনেননি বলে সোমবার সুদীপ্ত সেন যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে কুণালকে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। উত্তরে তিনি জানান, গত ১০, ১১ ও ১২ এপ্রিল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। কুণাল বলেন, “সেখানেই মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবির প্রসঙ্গ ওঠে। সুদীপ্তও কিছু বলেন। কিন্তু আজ সকালে কাগজে যা পড়লাম, তার সঙ্গে সেই সময়ের (সুদীপ্তর) কথার কোনও মিল নেই। তবে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বিক্রির টাকার অঙ্ক নিয়ে যা বলা হচ্ছে, সে কথা সুদীপ্ত বলেননি।” এর পরেই কুণালবাবু বলেন, “সুদীপ্ত কী বলেছেন (ছবি নিয়ে), তা আমি তদন্তকারীদেরই বলব। মিডিয়াকে এখন বলব না।”


রাজাবাজারের সভায় মুখ্যমন্ত্রী ও মুকুল রায়। ছবি: সুমন বল্লভ।

কুণালকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সারদা কেলেঙ্কারিতে মদনবাবুর নাম উঠেছে। তাঁকে কি তদন্তে ডাকা উচিত? জবাবে কুণাল বলেন, “মদন মিত্রকে অনেক আগেই তদন্তকারীদের ডাকা উচিত ছিল। তাঁকে গার্ড করে রাখা হয়েছে।” তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “যাঁরা সারদার মঞ্চে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিয়েছেন, সারদা-র এজেন্টদের পাশে নিয়ে বলেছেন, এই সংস্থা ভাল, তাঁদের কেন ডাকা হচ্ছে না?” এত ক্ষণ অবধি সাংবাদিকদের সঙ্গে কুণালকে কথা বলতে বাধা দেয়নি পুলিশ। কিন্তু এই সব কথাবার্তা বলার পরেই পুলিশকর্মীরা তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁকে আদালতের ভিতরে ঢোকানোর জন্য টানতে থাকেন পুলিশকর্মীরা।

টানাটানির মধ্যেই চিৎকার করে কুণাল বলেন, “আমাকে জেলে আটকে রেখে মঞ্চে আমায় গালাগাল দেওয়া হচ্ছে। এটা চলতে পারে না। আমাকে কথা বলতে দিন, না হলে এখানেই বসে পড়ব।” এ কথা শুনে পুলিশ একটু থমকে যায়। কুণাল ফের বলতে থাকেন, “ইডি, সেবি যে সংস্থাই তদন্ত করুক না কেন, বারবার বলছি, আমাকে ও সুদীপ্ত সেনকে মুখোমুখি বসানো হোক। বসাতে আপত্তি কোথায়? কেন এত ভয়?” এর পরেই কুণাল অভিযোগ করেন, “পুলিশের কাজ হচ্ছে, সারদায় যারা সুবিধা নিয়েছে, তাদের দালালি করা।”

কুণাল চিৎকার করে বলতে থাকেন, “কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ কেন সারদা-র অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন? কোন কাণ্ডজ্ঞানে সুদীপ্ত সেনকে তিনি ভাল বলেছিলেন? তাঁকে কেন তদন্তের স্বার্থে ডাকা হবে না?” এর পরেই পুলিশ তাঁকে টেনে আদালতের ভিতরে ঢুকিয়ে নেয়।

দ্বিতীয় দফার নাটক শুরু হয় বেলা আড়াইটে নাগাদ। ওই সময়ে তিন তলার আদালতের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামিয়ে আনা হচ্ছিল কুণালকে। পাছে কুণাল সাংবাদিকদের আরও কিছু বলে ফেলেন, সে জন্য তাঁকে কার্যত ঘিরে ফেলেন পুলিশকর্মীরা। কিছু বলতে গেলেই কুণালকে বাধা দেওয়া হতে থাকে। ক্যামেরা আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ে পুলিশ। টানাহেঁচড়ার মধ্যে পুলিশের বেষ্টনী ছাড়িয়ে সিঁড়িতেই বসে পড়েন তিনি। চিৎকার করে পুলিশকে তিনি বলেন, “মিডিয়াকে কেন আটকাচ্ছেন? আমাকে ওদের সঙ্গে কথা বলতে দিন।” এই কথা বলা মাত্রই পুলিশের সঙ্গে কুণালের প্রবল ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। এই চাপাচাপির মধ্যে বার কয়েক সিঁড়িতে বসে পড়েন কুণাল। পরে ফের কিছুটা উপরে উঠে যান। এর মধ্যে গলা চড়িয়ে, আঙুল তুলে তিনি পুলিশকে বলতে থাকেন, “আমাকে বলার সুযোগ দিন। আপনারা আমাকে আটকাতে পারেন না। এটা কোর্টের বাইরে...ইউ কান্ট টাচ মি।”

বেগতিক দেখে পুলিশ তাঁকে প্রায় জাপটে ধরে নিয়ে যায় ময়ূখ ভবনের দোতলায় সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদের কার্যালয়ে। সেখানে গিয়েও থামেননি কুণাল। পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে থেকেই চিৎকার করে বলতে থাকেন, “এই মুখ্যমন্ত্রী, এই সরকার, এই পুলিশ যাঁরা সুদীপ্ত সেনকে চিনতেন, যাঁরা সুদীপ্ত সেনের মিডিয়ার সুবিধা নিতেন, তাঁদের আড়াল করছে।” এর পর গলার স্বর আরও চড়িয়ে কুণাল অভিযোগ করেন, “পুলিশ তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করছে।”

এই সময়ে পুলিশ কুণাল ঘোষকে আড়াল করে ফের ময়ূখ ভবনের আদালতের লক-আপে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। প্রবল চিৎকার করে কুণাল বলে চলেন, “আমার কোনও কথা শোনা হচ্ছে না। আমার ‘পয়েন্ট’ নেওয়া হচ্ছে না। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না।” এর মধ্যে পুলিশ কুণালকে আদালতের লকআপে ঢুকিয়ে ফেলে। ঘটনাটি ঘটে প্রায় ১৫ মিনিট ধরে।

এর মধ্যে সল্টলেকের আরও দু’টি থানা থেকে পুলিশ আনা হয়। আদালত চত্বর পুলিশে ছয়লাপ হয়ে যায়। এ দিনের মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত হিসাবে আদালতে হাজির করানো হয়েছিল সুদীপ্ত সেনকেও। বেলা সওয়া তিনটে নাগাদ পুলিশ তাঁকে পুলিশের গাড়িতে তোলে। সুদীপ্তকে প্রশ্ন করা হয়, ছবি বিক্রি নিয়ে কুণালের সঙ্গে তাঁর কি কোনও কথা হয়েছিল? উত্তরে সুদীপ্ত বলেন, “ও সব বাজে কথা।”

এর ২০ মিনিট পরে পুলিশ কর্ডন করে গাড়িতে তোলা হয় কুণালকে। গাড়িতে ওঠার সময় তৃণমূলের সাংসদ ফের চিৎকার করে বলেন, “এত ক্ষণ সুদীপ্ত সেনকে নিয়ে গোপনে বৈঠক করেছে পুলিশ। পুলিশ ওঁকে সব শিখিয়ে দিয়েছে।”

কুণালের এই সব অভিযোগের উত্তরে অবশ্য কিছু বলতে চায়নি সল্টলেক পুলিশ। গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষ এ দিন রাতে বলেন, “কোনও অভিযুক্তের তোলা অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্য করব না।” কলকাতা পুলিশের কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থর প্রতিক্রিয়া, “আমি তো আগেই বলেছিলাম, এ ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন অভিযোগের প্রতিক্রিয়া দেওয়ারই কোনও মানে হয় না।”

হলদিয়ায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র শুধু বলেন, “উনি (কুণাল) তো মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। এখন জেলে আছেন। তৃণমূলের বাকি যাঁরা আছেন, তাঁরা ভাবুন, ওখানে যেতে তাঁদের কত দিন লাগবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sarada kunal mamata mukul roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE