Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সত্যি কী ঘটেছিল, দুই জখমের বয়ান দু’রকম

ছাত্র সংঘর্ষে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন দু’জনেই। ছিলেন একই ওয়ার্ডে। বছর তিনেক আগের সেই রাতে তৃণমূল নেতা সজল ঘোষ খুনের পর পুলিশের কাছে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেন এক জন। অন্য জন গ্রেফতার হন অভিযুক্ত হিসেবে। আদালত ইতিমধ্যেই মামলার পাঁচ অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করেছে। কিন্তু সেই রাতে ঠিক কী ঘটেছিল, রহস্য কাটেনি। অসঙ্গতি ধরা পড়ছে সে দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকা দু’পক্ষের দু’জনের বিবরণেও।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৫৭
Share: Save:

ছাত্র সংঘর্ষে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন দু’জনেই। ছিলেন একই ওয়ার্ডে। বছর তিনেক আগের সেই রাতে তৃণমূল নেতা সজল ঘোষ খুনের পর পুলিশের কাছে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেন এক জন। অন্য জন গ্রেফতার হন অভিযুক্ত হিসেবে।

আদালত ইতিমধ্যেই মামলার পাঁচ অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করেছে। কিন্তু সেই রাতে ঠিক কী ঘটেছিল, রহস্য কাটেনি। অসঙ্গতি ধরা পড়ছে সে দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকা দু’পক্ষের দু’জনের বিবরণেও।

২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি দুপুরে বর্ধমানের পূর্বস্থলী কলেজে মনোনয়ন জমা নিয়ে সংঘর্ষে আহত হন টিএমসিপি-র শৌভিক আইচ ও হালিম শেখ। জখম হন এসএফআইয়ের সন্তু ভৌমিকও। তিন জনকেই নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। তৃণমূলের অভিযোগ, দুই টিএমসিপি সমর্থককে দেখতে রাতে হাসপাতালে যান তৃণমূল নেতা তপন চট্টোপাধ্যায়, সজল ঘোষ-সহ কয়েক জন। হাসপাতাল চত্বরেই খুন হন সজল।

তৃণমূলের পাঁচ ‘প্রত্যক্ষদর্শী’র অভিযোগে গ্রেফতার হন সিপিএমের পূর্বস্থলীর জোনাল সদস্য প্রদীপ সাহা ও সন্তু-সহ পাঁচ জন। মূল অভিযুক্ত লোকনাথ দেবনাথ এখনও পলাতক। কিন্তু গত বুধবার ধৃতেরা বেকসুর খালাস হওয়ায় অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সিপিএমের দাবি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেই অন্যত্র খুন করে সজলকে হাসপাতালে এনে ফেলা হয়।

আদালতে যিনি নিজেকে ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেছিলেন, সেই শৌভিক ঠিক কী হয়েছিল তার বিবরণ দিতে রবিবার বলেন, “সে দিন দুপুরে গোলমাল এড়াতে দু’পক্ষের মনোনয়ন জমার আলাদা সময় ধার্য হয়েছিল। কলেজের সামনে সকাল থেকে খুব ভিড় ছিল। প্রথমে আমরা মনোনয়ন জমা দিতে যাই।” তাঁর অভিযোগ, “কলেজ যাওয়ার সময়ে দেখি, প্রদীপ সাহার বাড়ির সামনে এসএফআই নেতা লোকনাথ-সহ অনেকে জড়ো হয়েছে। মনোনয়ন জমা দিয়ে যখন বেরোচ্ছি, ওরা এসে মারধর শুরু করে। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। পরে জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে।”

শৌভিকের দাবি, তাঁকে ও হালিমকে হাসপাতালে ভর্তি করার কিছু ক্ষণ পরে সন্তুকে ভর্তি করানো হয়। ৮ ও ৯ নম্বর শয্যায় তিনি ও হালিম এবং ১৪ নম্বরে সন্তু ছিলেন। হাসপাতালে উত্তেজনা ছিল না। তাঁর বিবরণ, “রাত ১১টার খানিক আগে বিধায়ক তপনবাবু, সজলকাকারা আসেন। তখন অপরিচিত একটি টাক মাথা ছেলে সন্তুর সঙ্গে এসে কথা বলছিল। সে চলে গেলে সন্তু বলে, লোকনাথ হাসপাতালের নীচে এসেছে, কথা বলতে চায়। তপনবাবু আমাকে বলেন, ‘গিয়ে দেখ কী বলতে চায়’। সজলকাকাকে নিয়ে আমি নীচে নামি। হাতে স্যালাইনের চ্যানেল থাকায় রক্ষী আটকে দেন। গেটের বাইরে লোকনাথ দাঁড়িয়েছিল। সজলকাকাকে দেখিয়ে দিই, ‘ওই যে লোকনাথ’। তিনি বাইরে বেরোতেই খুন হন।”

এসএফআই সমর্থক সন্তুর বিবরণ আলাদা। তাঁর অভিযোগ, “সে দিন কলেজের সামনে টিএমসিপি প্রচুর ছেলে জড়ো করেছিল। গোলমাল পাকানোর মতলব রয়েছে বুঝে আমরা কিছু দূরে প্রদীপবাবুর বাড়িতে ছিলাম। ওরা মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরে আমাদের ছেলেরা যেতেই মারতে শুরু করে। আমি মাথায় বাঁশের আঘাতে জ্ঞান হারাই। তা দেখে পুলিশ লাঠি চালালে হালিম ও শৌভিক ঘা খায়। কলেজ ফাঁকা হলে পুলিশ আমাকে তুলে হাসপাতালে পাঠায়।”

সন্তুর দাবি, হাসপাতালের পুরুষ বিভাগে ঢুকে ডান দিকের এক কোণের শয্যায় ছিলেন তিনি। উল্টো দিকের কোণে ছিলেন হালিম। কিন্তু শৌভিককে তিনি শয্যায় দেখেননি। সন্তুর অভিযোগ, “ওকে ঘোরাফেরা করতে দেখছিলাম। সারা দিন প্রচুর লোক হালিমের কাছে আসা-যাওয়া করছিল। ওরা আমাকে লক্ষ করে মন্তব্য করছিল। আমার কাছে বাবা, মা, দিদি ছাড়া কেউ ছিল না। বেশ ভয় লাগছিল।” সন্তু দাবি করেন, “সন্ধ্যার পরে ওয়ার্ড ফাঁকা হয়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে। দেখি, ওয়ার্ড লোকে লোকারণ্য। সামনে ট্রলিতে বুকে ব্যান্ডেজ নিয়ে এক জন শুয়ে। হঠাৎ কয়েক জন আমাকে মারধর শুরু করে। স্যালাইনের নল ছিঁড়ে, স্ট্যান্ড দিয়ে মারে। পরে পুলিশ আমাকে নবদ্বীপ থানায় নিয়ে যায়।”

দু’জনের এই বয়ান থেকে উঠে আসছে অসঙ্গতি। প্রথমত, শৌভিক জানিয়েছেন, তিনি ও সন্তু কয়েকটি শয্যার তফাতে শুয়েছিলেন। কিন্তু সন্তুর দাবি, শৌভিককে তিনি দেখেননি। দ্বিতীয়ত, সন্তুর দাবি, তাঁর কাছে সন্ধ্যার পরে কেউ আসেননি। অথচ শৌভিক জানান, টাক মাথা একটি ছেলে আসে। তৃতীয়ত, লোকনাথ হাসপাতাল চত্বরে এসেছেন কি না, তা তিনি জানতেন না বলে দাবি সন্তুর। শৌভিকের দাবি, সন্তুই জানান লোকনাথ এসেছে। চতুর্থত, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে বহু লোক হালিমের সঙ্গে দেখা করতে এসে তাঁকে হুমকি দিচ্ছিল, অভিযোগ সন্তুর। শৌভিকের দাবি, কলেজে অশান্তি হলেও হাসপাতালের পরিবেশ ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। কেউ হুমকি দেননি।

যাঁদের সঙ্গে দুপুরেই সংঘর্ষ হয়েছে, সেই লোকনাথ ডাকছে শুনে কেনই তিনি দেখা করতে গেলেন, নীচে নামলেনই বা কেন, তার সদুত্তর মেলেনি শৌভিকের কাছে। তপনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। প্রদীপবাবু বলছেন, “ঠিক কী হয়েছিল, সেটা এখন আমরাও জানতে চাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debasish bandyopadhyay sajal ghosh murder case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE