Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘এটা সিক্রেট, কাউকে বলতে নেই’

প্রমোদকাকুর সঙ্গে সন্ধের ‘আইসক্রিম রাইড’গুলো ভাল লাগত না ছোট্ট শ্রেয়ার। অস্বস্তি হতো, খারাপ লাগায় ছেয়ে থাকত সময়টা। কাউকে বলতে পারেনি। বলতে পারেনি, প্রমোদকাকু কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে ওর ফ্রকের ভিতরে হাত ঢুকিয়েছেন দিনের পর দিন।

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:০৯
Share: Save:

প্রমোদকাকুর সঙ্গে সন্ধের ‘আইসক্রিম রাইড’গুলো ভাল লাগত না ছোট্ট শ্রেয়ার। অস্বস্তি হতো, খারাপ লাগায় ছেয়ে থাকত সময়টা। কাউকে বলতে পারেনি। বলতে পারেনি, প্রমোদকাকু কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে ওর ফ্রকের ভিতরে হাত ঢুকিয়েছেন দিনের পর দিন।

কয়েক বছর পরে যখন ওর ভাই রোহনকে নিয়ে আইসক্রিম রাইডের প্রস্তাব রাখলেন প্রমোদকাকু, ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল শ্রেয়া। মায়ের চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ‘‘রোহনকে পাঠাবে না প্রমোদকাকুর সঙ্গে। ওঁর আদরটা স্বাভাবিক নয়।’’

রোজ স্কুল থেকে ফিরে জামা বদলাত রিয়া। বাবার কাছে। বদলাত নয়, বদলাতে বাধ্য হতো। কিন্তু কোনও দিন বলতে পারেনি, জামা বদলানোর সময়ে ওকে ‘অন্য রকম আদর’ করে বাবা। বাবা বলেছিল, এটা ‘সিক্রেট’। কাউকে বলতে নেই। বলতে পারেওনি রিয়া।

দাদুর সঙ্গে খেলা করার কথায় ছেলের অস্বস্তি খানিকটা বুঝেছিলেন গৃহবধূ সৌমিতা। শ্বশুরমশাইয়ের থেকে আড়াল করতে চাইতেন ছেলেকে। বলেছিলেন স্বামীকে। স্বামীর বিস্মিত ও অশ্লীল প্রতিক্রিয়ার পরে আর কিছু করতে পারেননি।

এ রকম অসংখ্য অস্বস্তি নিয়ে খোলা মঞ্চে গলা উঁচিয়ে কথা বলার সুযোগ করে দিল শহরের এক অনুষ্ঠান। শিশুদের যৌন হেনস্থা এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা অস্বস্তির কথা উঠে এল এক নাটক এবং তার পরের প্রশ্ন-উত্তর পর্বে। নিজেদের আলোচনার মাধ্যমেই নানা প্রান্তের ছাত্র-ছাত্রী-অভিভাবকেরা জানলেন, শিখলেন, বললেন— ‘চিৎকার করো’। লজ্জা-ভয় নয়, প্রতিবাদই অস্ত্র। শিশুর যৌন হেনস্থা রোখার প্রথম ও প্রধান ধাপ আলোচনাই। চুপ করে থাকলে সমস্যা বাড়েই।

এই নাটকেই দর্শকেরা দেখলেন, আটের দশকের লেখিকা থেকে আজকের স্কুলছাত্রী— কেউ রেহাই পাননি এই সমস্যা থেকে। সমস্যার বেশির ভাগই জন্মেছে পরিবারে। ‘নিজের লোক’-এর হাতে। নাটকের শেষে দর্শকেরাও বললেন একই কথা। কেউ জানালেন, এ নিয়ে কথা বলার সাহস পাননি এত দিন। কেউ সন্তানের কথা বলতে গিয়ে কাঁদলেন অঝোরে। কেউ বা চল্লিশের কোঠায় এসে প্রথম বার প্রকাশ করলেন নিজের ছোটবেলার অন্ধকার দিনের কথা।

নাটক শেষে উপস্থাপক প্রশ্নে প্রশ্নে ছুড়ে দিলেন বিতর্ক। উঠে এল, শিশুর হেনস্থার বিষয়টি না-বুঝতে পারার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী তার মা-ই কি না। নিজেরাই জোর গলায় বলতে শিখলেন, হেনস্থার দায় শুধুমাত্র হেনস্থাকারীরই। সচেতনতার প্রশ্ন যেখানে উঠছে, সেখানে একা মা নন, বাড়ির প্রতিটি সদস্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ। হেনস্থাকারী যদি বাবা হন, দাদা হন, দাদু হন, কাকু হন, তবে সেই পারিবারিক কলঙ্ক সামনে আনা কতটা সম্মানের? জবাব দিলেন নিজেরাই। হেনস্থাকারীর একটাই পরিচয়, সে হেনস্থাকারী। পারিবারিক সম্পর্কের দোহাই দিয়ে তাকে আড়াল করতে চাওয়া মানে শিশুটির প্রতি অবিচার।

বস্তুত, সমস্যাটা নতুন নয়। নতুন নয় অবিচার বা তার সচেতনতাও। এই বিষয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক তথ্যচিত্র। ছোট্টবেলা থেকে শিশুকে সচেতন করতে, তাদের বোঝার মতো করে তৈরি হয়েছে ‘গুড টাচ-ব্যাড টাচ’-এর মতো অ্যানিমেশন ফিল্ম। হাল আমলের মূল ধারার হিন্দি ছবি দেখিয়েছে, বাবার বন্ধুও কখনও হয়ে উঠতে পারেন আতঙ্কের কারণ। ‘হাইওয়ে’ সিনেমায় উচ্ছ্বল তরুণী বীরার চরিত্রে সে কথাই বলেছিলেন আলিয়া ভট্ট। ‘মনসুন ওয়েডিং’ ছবিতেও মীরা নায়ার দেখিয়েছিলেন, কী ভাবে দশ বছরের খুদের বিশ্বাস ভেঙেছিল তার খুবই কাছের জন।

অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষও বললেন সে কথা। জানালেন, ছোটবেলায় কোনও না কোনও কাছের আত্মীয়ের হাতে অন্তত এক বার যৌন হেনস্থার শিকার হয়নি, দেশ-কাল-জাতি নির্বিশেষে এমন শিশু বিরল। এর সবচেয়ে বড় কারণ, শিশুরা সহজ ‘টার্গেট’। তারা ভয় পাবে, লজ্জা পাবে, কুঁকড়ে থাকবে, কিন্তু গলা তুলে প্রতিবাদ করবে না। পরিচিত মানুষের ‘আদরের’ মুখে চট করে ‘না’ বলতে শেখেনি তারা। এই সুযোগটাই নেন অনেকে। শাশ্বতীদেবী বললেন, ‘‘শিশু অনেক সময়ে হয়তো বলতেও পারে সমস্যার কথা। প্রকাশ করতে পারে আপত্তি। কিন্তু তার কথা বিশ্বাসই করতে চান না বড়রা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বিশ্বাস করেন। কিন্তু শিশুর সুরক্ষার সঙ্গে আপস করে নেন লোকলজ্জার ভয়ে। শিশুর সবচেয়ে বড় সুরক্ষার বিনিময়ে নিশ্চিত করে নেন নিজেদের সামাজিক অবস্থান।’’

এই জায়গাটাই বারবার করে ছুঁয়ে গেল ছকভাঙা ওই নাটক। যার ইউএসপি— ‘ছায়া-অভিনয়’। সাদা পর্দার পিছনে ছায়ামূর্তির নড়াচড়া। সেই ছায়ায় ছায়ায় অভিনীত হচ্ছে হেনস্থার দৃশ্য। আর ছায়ার বাইরে কথা বলছে, বাস্তবের চরিত্ররা। বলছে হেনস্থার গল্প। জীবনের কালো দিনগুলির গল্প। বলছে স্পষ্ট ভাষায়, চোখে চোখ রেখে। লুকিয়ে না-কেঁদে, কুঁকড়ে না-থেকে, লজ্জায় মুখ না-ঢেকে মুখোমুখি লড়তে শেখাচ্ছে এই সামাজিক অসুখের সঙ্গে।

কিন্তু কোথা থেকে আসে এই বিকৃতি? কী ভাবেই বা যৌন আকর্ষণের আওতায় ঢুকে পড়ে নিজের সন্তান বা সন্তানসম শিশুরা?

মনোবিদ প্রশান্ত রায় জানালেন, চিকিৎসার পরিভাষায় একে বলে ‘পিডোফিলিয়া।’ কার ক্ষেত্রে ঠিক কোন বিকৃতির জন্য এমনটা হয়, তা নির্দিষ্ট করা মুশকিল। তবে মনস্তত্ত্বের ভাষায় তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘এই ধরনের যৌন লালসা আসলে মানুষের জৈব প্রবৃত্তি থেকেই আসে। কোনও এক জন বাবা তাঁর মেয়ের উপর যৌন হেনস্থা করেন সেই প্রবৃত্তি থেকেই। কিন্তু, সেই প্রবৃত্তিকে আড়াল করে রাখে সামাজিক মূল্যবোধ। এই দু’টির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে না-পারাটাই সমস্যা ডেকে আনে।’’

সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র আবার এমন সমস্যা বেড়ে চলার জন্য দায়ী করছেন মানুষের বিজ্ঞাপন-বিলাসকে। জানালেন, সমাজের গতিপ্রকৃতিতেই লুকিয়ে আছে এই অসুখের বীজ। তিনি বলছিলেন, ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনগুলির কথা। যেখানে এক জন নারীর ত্বকের যৌন আবেদন বোঝাতে ব্যবহৃত হয় ‘শিশুর মতো ত্বক’ শব্দবন্ধটি। বলছিলেন ছোটদের রিয়্যালিটি শো-গুলির কথা, যেখানে আবার এক জন শিশুকে তার ভাবভঙ্গি দিয়ে প্রাণপণে অনুকরণ করানো হয় ‘বড়দের মতো’ আচরণ। তার নাচের সময় কোমরের মোচড় যেন হয় ‘বড়দের মতো’ নিখুঁত, অবাক হওয়ার ভঙ্গি যেন হয় ‘বড়দের মতো’ পরিণত। ‘‘এ ভাবে নিজেদের অজান্তেই আমরা ‘সেক্স অবজেক্ট’ হিসেবে উপস্থাপন করে ফেলছি শিশুদের। আর এর প্রভাব যে কতটা গভীরে যেতে পারে, তার কোনও আন্দাজই করতে পারছি না।’’

যে অনুষ্ঠানের এ ভাবে খোলা মনের মঞ্চ হয়ে ওঠা, তার উদ্যোক্তা ছিল শিশু ও নারী সুরক্ষা সংগঠন ‘রাহি ফাউন্ডেশন’। সম্প্রতি শহরে এসে এক মাসব্যাপী সচেতনতা অনুষ্ঠান করে গেল রাহি। সঙ্গী ছিল ‘আর্টস ফরোয়ার্ড’। তাদের উপস্থাপনায় অভিনীত হল ‘আউট অব শ্যাডোজ’ নাটক। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা অনুজা গুপ্ত জানালেন, শিশুদের যৌন হেনস্থা কোনও বিশেষ শ্রেণিতে আবদ্ধ নয়। শিশু হেনস্থার শিকার কি না, সে বিষয়ে সচেতন হওয়া সবচেয়ে বেশি দরকার অভিভাবকদেরই। শি‌শুকে নির্ভয়ে বলতে দিতে হবে তার সমস্যা। তাকে বিশ্বাস করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, যা হয়েছে তাতে তার কোনও অপরাধ নেই। বোঝাতে হবে, পাশে আছি। গুরুত্ব বুঝে প্রয়োজন কাউন্সেলিংয়েরও। অনুজা বললেন, ‘‘আমরা প্রয়োজনে বাবা-মায়েরও কাউন্সেলিং করাই। প্রথমে এটা বোঝানো জরুরি, শিশুর যৌন হেনস্থা লুকিয়ে রাখার মতো বিষয় নয়। সামনে আনাটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’’

কলকাতার নাট্য সংগঠন ‘আর্টস ফরোয়ার্ড’-এর পরিচালক পারমিতা সাহা বললেন, ‘‘সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এগিয়ে এসেছিলাম আমরা। শুধু মঞ্চের কিছু অভিনয় নয়, চেয়েছিলাম সেই অভিনয়ের সঙ্গে নিজেকে যেন মেলাতে পারেন দর্শকরাও। তাঁরা যেন বলতে পারেন তাঁদের কথাও।’’ সেটাই তো এই সমস্যা অতিক্রম করার প্রথম ধাপ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

NGO Sexual harrasment of child
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE