Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
International Women's Day

নারীকে মানুষ হতে হবে, পুরুষকেও

স্কুলের শুরুতে প্রার্থনাসঙ্গীত গাইবার সময় যতেক ফচকেমি তারও কোনও ভেদাভেদ নেই। লক্ষ্মী ছেলে এবং দুষ্টু মেয়ে সব রকমই ছিল দলে। সহপঠন আমাদের সমানানুভূতি দিয়েছিল।

ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সে আবার কী!

ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সে আবার কী!

তিলোত্তমা মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৮ ২০:৪৯
Share: Save:

মেয়ে আর মানুষ ছোটবেলাতেই এই দুটি শব্দ আমার মনে গোল পাকিয়ে ছিল। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে আমাদের বন্ধুদের দলটি ছিল বিশাল। ছেলের দল আর মেয়ের দলে আলাদা কিছু ছিল না। একই স্কুলে পড়ি। পাশাপাশি বসে একই রকম চেঁচামেচি ও নামতা-পড়া! স্কুলের শুরুতে প্রার্থনাসঙ্গীত গাইবার সময় যতেক ফচকেমি তারও কোনও ভেদাভেদ নেই। লক্ষ্মী ছেলে এবং দুষ্টু মেয়ে সব রকমই ছিল দলে। সহপঠন আমাদের সমানানুভূতি দিয়েছিল। তারা যা খেলে, আমরাও তা-ই খেলি। মাঝে মাঝে একসঙ্গে, কখনও বা আলাদাও। ক্রিকেট খেলিনি অবশ্য। ভলিবলও না। তবে ফুটবল ও ব্যাডমিন্টন সমান তালে খেলেছি। আমার দ্বারা হয়নি, কিন্তু আমার অনেক বান্ধবীই টেবিল টেনিসে দক্ষ ছিল।

ছোটবেলার প্রথম বিচার তো খেলাতেই। আমরা সব একজোট ডাং-গুলি, পিট্টু, আত্তিকা-পাত্তিকা খেলেছি যেমন, তেমনি কাবাডি বা দাঁড়িয়াবান্ধা! ঘুড়ি ওড়ানোর মরশুমে মাঠ থেকে আমাদের ঘরে ফেরানো মুশকিল। ফ্রক পরতাম ঠিকই। মেয়েদের পোশাক। সেটুকুই। ছেলের দলের সঙ্গে আমরাও গাছে উঠেছি, গুলতি মেরে ফল পেড়েছি, বাড়ির চালে চড়ে মায়ের শিম, কুমড়ো ফুল, এঁচোড় পেড়েছি। আমাদের চা-বাগানের বাঙালি পাড়া মিশে থাকত আদিবাসী ও নেপালি বন্ধুদের সঙ্গে, রাজবংশী, রাভা, মেচদের সঙ্গে। পঞ্জাবি ও বিহারি বন্ধুও অনেক। কেউ বলেনি, এর সঙ্গে মিশিস না, তার সঙ্গে কথা বলিস না, তোরা তো মেয়ে, তোদের ওটা করতে নেই। তবে রবীন্দ্রজয়ন্তী বা পূজাপার্বণে আয়োজিত নৃত্যনাট্যে মেয়েরা বেশি, দু’-একজন ছেলেই কেবল নাচে যোগ দিত। কেবল সে ক্ষেত্রেই আমরা ‘মেয়ে’ হয়ে উঠতাম আর নাচ করা ছেলেরা হত ‘লেডিস’!

আমরা কিছু মনে করিনি! নৃত্যগীত সম্পূর্ণ মেয়েলি কর্ম হলে আমাদের আপত্তির কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু আমরা উদয়শঙ্কর থেকে বিরজু মহারাজ পর্যন্ত জ্ঞান রাখতাম।

আমাদের পাড়ায় সুগায়কের অভাব মোটেও ছিল না। আমার অপরিণত মনে ছোট ছোট কয়েকটি প্রশ্ন জেগেছিল আপনিই। যেমন করে আমাদের ঝোপে-জঙ্গলে আপনি গজাত নানাবিধ ফুল!

আরও পড়ুন: ‘সিস্টারহুড’ বনাম ‘কাজের মেয়ে’রা

প্রশ্ন ছিল, শুধু বাবা-ই কেন আপিস যায়? মা নয় কেন? কাকি-জেঠি, মা-মাসি সকলে বড় সন্ত্রস্ত! ‘তোর বাবা আসবে! তোর কাকা ফিরবে!’ যেন বাবাদের এই ফেরা এমন এক পরীক্ষার মুখে মা-কাকিমাদের ফেলে দেয়, যাতে পাশ না করলে, আমাদের মতোই এক বছর নষ্ট!

নষ্ট! এক বছর তো নয়! তবে কী নষ্ট? কেন এমন ভয়? সেই ভয়ের আঁচ আমাদের মধ্যেও ঢুকে পড়ত খানিক। কেবল পাড়ার এক জেঠিমা হাসতে হাসতে ইস্কুলে যান। হিন্দি স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। কী আত্মবিশ্বাস চোখে-মুখে! উনি তো স্বাধীন! অন্য কাকিমারা বলাবলি করেন! ‘যা খুশি কেনার স্বাধীনতা আছে। কর্তার কাছে হাত পাততে হয় না।’

ভারী খারাপ লাগত শব্দটা! ‘কর্তা!’ তাঁদের কর্তালির রকমও যেহেতু চোখে পড়ত নানারকম, সেই প্রভুত্বপরায়ণতার সঙ্গে মনে মনে দ্বন্দ্ব ঘটে যাচ্ছিল আমার! ‘হাত পাতা’ বললে আমার ভিখিরির অনুষঙ্গ মনে পড়ত। মা-কাকিমাদের আমার লাগত মা দুর্গা একেকজন। তাঁদের সব কাজে, সব ক্ষেত্রে অমন নির্ভরশীল, ভিতু, দাস্যভাব আমায় পীড়ন করেছে! কবে, কোন শৈশবে আমি স্থির করলাম, আমি এস ডি ও হব! নয়তো ম্যাজিস্ট্রেট! মা দুর্গার স্তিমিত, হাত-পাতা রূপ আমার কখনও সহ্য হয়নি!

আরও পড়ুন: বাধার পাহাড় পেরনোর কাহিনি লিখছে চম্পারণ

তবুও তাকে আমি একজন ‘মেয়ে’ হওয়ার চেতনা বলতে পারি না! বরং তার প্রথম উদ্ভাস আমার ইউনিয়ন একাডেমি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। শুনতাম, মেয়েরা ওখানে হেরে যায়! ছেলেরাই সব ফার্স্ট-সেকেন্ড! নীল স্কার্ট আর সাদা শার্ট পরে আমি কী রকম জেদি হয়ে উঠলাম! সেই হয়তো প্রথম, মেয়ে হয়ে নিজেকে প্রমাণ করার পদক্ষেপ!

ঘরের কাজে আমার মন লাগত না। বই ছিল পরমসঙ্গী! ‘আমার জীবন’ বলতে আমি বুঝতাম অন্য রকম কিছু। ঠিক কেমন, তা বলা শক্ত। তবে ঠাকুমা যখন আমার হা হা হাসি শুনে বললেন, ‘মাইয়া মাইনষের শব্দ কইরা হাসতে নাই। লোকে অসইভ্য কইব...’

আমি মোটেই তাকে পাত্তা দিইনি। মেয়েমানুষ হিসেবে আমার আত্মোপলব্ধি খানিক পোক্ত হল একটু। যতই সমালোচিত হই, ঠ্যাং নাচানো বন্ধ করিনি, সাইকেল চালানোর বারণ মানিনি! যাদের সঙ্গে খেলি, সেই ছেলের দল, তাদের গোঁপের রেখা উঠতেই আমিও হয়ে গেলাম পরিপূর্ণ মেয়ে, নিষেধ বাড়ল! ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সে আবার কী!

কী আশ্চর্য! যাদের সঙ্গে শৈশব, কৈশোর যাদের সঙ্গে খেলা, পড়া, আড্ডার নির্মল ভালবাসার সম্পর্ক, তাদের বন্ধু বলব না? বন্ধুর লিঙ্গবিচার হয় না! আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম তা বোঝেনি। আমরা, সেইসব বন্ধুরা, ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে লড়াই চালিয়ে গিয়েছি। আজও সেই বন্ধুত্ব অটুট! একসময় অভিভাবকের দল মানতে বাধ্য হয়েছেন, একটি ছেলে ও একটি মেয়ে মানেই প্রণয়লীলা নয়! এ-ও এক স্বাধীনতার যুদ্ধ। আমি ও আমার বন্ধুরা জীবন দিয়ে বুঝেছি। কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সখা ছিলেন। লোকে মহাভারত স্মরণ করে, বার্তা নেয় কতটুকু?

একজন নারীর স্বাধীন মানুষ হয়ে ওঠার পথ অমসৃণ পাথরের। কণ্টকময়। তার মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য যেমন, তেমনি সম্পর্কগুলি সংজ্ঞায়িত ও মর্যাদাব্যঞ্জক করে তোলাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নারী তার লক্ষে অনেক দূর এগিয়েছে। একজন পেশাদার মহিলার সম্পর্ক শুধু সমাজ-নির্ণীত প্রাচীন সম্পর্কগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তার জীবনে পুরুষ সহকর্মী আছে, বন্ধু আছে, পেশাগত যোগাযোগ আছে, সহযাত্রী আছে, দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য যোগাযোগ আছে। সেই সবই একজন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক। মানুষের সঙ্গে মানুষের। এই ক্ষেত্রটি সহজে তৈরি হয় না!

জীবন বড় বিচিত্র! শৈশব ও কৈশোর জুড়ে আমার যে স্বাধীনতার উপলব্ধি, তার বিপরীত প্রান্তে গিয়ে আমি উঠেছিলাম, এক ভুল ভালবাসার নৌকা চেপে। এ যেন ‘তাসের দেশ’-এর রাজপুত্রের বাণিজ্যতরী! আমাকে এমন এক সংসার সমুদ্র পাড়ে আছড়ে ফেলেছিল, যা দিয়ে, নারীজন্মের এমন সব অবমাননা, পারিবারিক অত্যাচার ও হিংসার অভিজ্ঞতা লাভ করলাম, যা, আমার মা-মাসি-কাকি-জেঠি, এমনকী ঠাকুমা-দিদিমাও ভোগ করেননি!

এর ফল হল বেশ চমকপ্রদ! এক, একটি মেয়ের মেয়েমানুষতার বেদনা কত গভীর ও নির্জন, আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি। তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের লক্ষ্য, প্রতিজ্ঞা ও মর্যাদা প্রদানের যতেক আয়োজনের প্রতি আমার সমর্থন আছে। দুই, আমি পুরুষের সমান হওয়াই আমার স্বাধীনতার লক্ষ্য, মনে করি না, কারণ সমাজে পুরুষের শৃঙ্খল যথেষ্ট জটিল এবং অনেক ক্ষেত্রেই মনুষ্য মর্যাদাসঞ্জাত নয়। আমি এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছি, নারীকে যেমন মানুষ হতে হবে, পুরুষকেও তেমনি। তিন, আমার ভুল জীবনের যন্ত্রণার পাঁকে আমার কাব্য-সাহিত্যকমলিনীর জন্ম! অবমানিত নতমুখী মেয়ের শিরে সরস্বতীর আশীর্বাদ লাভ!

সাহিত্যিক পরিচয়ের আভায় নারী হিসেবে আমার সম্মান ও অবমাননা দুই-ই জোটে। এখনও আমার ‘নারী’ পরিচয়কে ব্যক্তি পরিচয়ে পৌঁছে দেবার যুদ্ধ শেষ হয়নি। কবে হবে, তার ধারণাও আমার নেই। কারণ, আমি এবং আমরা যখন চাইছে সুকৃতি ক্ষেত্রে লিঙ্গবিভাজন লুপ্ত হোক, তখন বিশ্ব জুড়ে গে রাইটার বলছেন— আমি গে। অনেক নারী আজও পদোন্নতির জন্য নারীত্ব বিক্রয় করছে। বহু পুরুষ আজও মনে করছেন— মেয়েরা ততখানি বুদ্ধি ধরে না, যতখানি তাদের লাস্য!

তবু আমরা এগোচ্ছি। প্রগতির বার্তা সমেত আমাদের নিশান নমিত হবে না কখনও। আমাদের যতই মারুক, মানবিকতার জয়গান গাইতে গাইতে বেঁচে উঠব ফের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE