Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

‘জন্ম থেকে মেয়েদের রান্না জানতে হবে?’

মেয়েদের কর্মক্ষেত্র বলতে কি শুধুই রান্নাঘর? রান্না করা খাবার ও কাজের প্রশংসা-তিরস্কার কি তাঁর জীবনের একমাত্র প্রাপ্তি? সম্প্রতি বম্বে হাইকোর্টের এক মামলায় রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেই প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে।

সুপ্রিয় তরফদার
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৮ ০১:৪১
Share: Save:

মেয়েদের কর্মক্ষেত্র বলতে কি শুধুই রান্নাঘর? রান্না করা খাবার ও কাজের প্রশংসা-তিরস্কার কি তাঁর জীবনের একমাত্র প্রাপ্তি? সম্প্রতি বম্বে হাইকোর্টের এক মামলায় রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেই প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে।

ভাল রাঁধতে ও ঠিক মতো ঘরের কাজ করতে বলাকে কেন্দ্র করে নিরন্তর স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর গোলমাল হত বলে অভিযোগ। এই ‘মানসিক নির্যাতনে’র ফলেই একদিন আত্মহত্যা করেন স্ত্রী। বম্বে হাইকোর্টে এ নিয়ে মামলা হয়। সেই মামলার রায় দিতে গিয়ে সম্প্রতি বিচারপতি সারঙ্গ কোতওয়াল বলেন, ‘‘শুধু ভাল করে রান্না বা ঠিকমতো বাড়ির কাজ করতে বলার মানে এই নয় যে, মৃতার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হত। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনা’ হিসেবে যে ধরনের মানসিক নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে, তেমন নির্যাতনের সপক্ষে প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি সরকারি আইনজীবী।’’

এর পরেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। একাংশের মতে, সমাজের অধিকাংশের মানসিকতায় কার্যত মরচে ধরে রয়েছে। রান্না করা বা ঘরের কাজ করার দায়িত্ব একা মহিলার নয়, পুরুষশাসিত সমাজের অনেকেই এ কথা আজও মানেন না। অথচ দুনিয়ার অধিকাংশ রন্ধনশিল্পী কিন্তু পুরুষ। সেখানে বাড়িতে ক’জন পুরুষ রান্না ও ঘরের কাজে এগিয়ে আসেন? প্রশ্নটা সেখানেও।

নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষের প্রশ্ন, ‘‘জন্ম থেকে মেয়েদের কি রান্না জানতেই হবে? না হলে এটা কেন ধরে নেওয়া হবে যে রান্না করাটা মেয়েদের প্রধান কাজ, পুরুষের নয়? এ জন্য তিরস্কার বা বিদ্রুপ অতি অবশ্যই মানসিক নির্যাতনের সমান।’’ তবে এই পরিস্থিতির জন্য মহিলাদের একাংশকেও দায়ী করছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক মহিলা রান্না করে কাঁচুমাচু হয়ে বলেন, ‘রান্নাটা ভাল হল না।’ তাঁরা খারাপ রান্না করাকে নিজেদের খামতি মনে করেন। এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’’

সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র বলেন, ‘‘নারীকে সমাজে এখনও পিছনে সরিয়ে রাখার এই প্রবণতা খুবই দুর্ভাগ্যের। সে কারণেই প্রতিনিয়ত নারীকে মূল্যহীন প্রতিপন্ন করতে তিরস্কার করা হয়। ভাল রান্না বা ঘরের কাজ ছোট উদাহরণ মাত্র।’’ অভিজিৎবাবু মনে করেন, ‘‘এ ধরনের নির্যাতন ফৌজদারি অপরাধের সমান। বিচারপতি যে বিধির কথা বলেছেন তা বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরিবর্তন করার প্রয়োজন।’’

মহিলাদের একাংশের মতে, স্ত্রীর রান্না করা খাবার চাওয়া স্বামীর ভালবাসার একটি দিক হতে পারে। কিন্তু সেটা বাধ্যতার জায়গায় পৌঁছলে তা সমাজের ক্ষেত্রে মোটেও ভাল হবে না। নারী পুরুষের সমানাধিকার নিয়ে আলোচনার আগে সমাজের কিছু অংশে জমে থাকা আবর্জনা সাফ করা প্রয়োজন। মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বলছেন, ‘‘কোনও স্বামী তাঁর স্ত্রীর কাছে রান্নাটা ভাল করার কথা বলতেই পারেন, কিন্তু তা বলার একটা ধরন রয়েছে। সেটা কী ভাবে এবং কত দিন ধরে বলা হচ্ছে, তার উপরে নির্ভর করছে বিষয়টি মানসিক নির্যাতন কি না। বারবার কাউকে মূল্যহীন প্রমাণ করার চেষ্টা করা হলে তা তাঁকে চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্য করতে পারে।’’

সাম্প্রতিক বাংলা ছবির একটি দৃশ্যে প্রৌঢ়া স্ত্রীকে স্বামীর উদ্দেশে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘কথা তো ছিলই, তুমি বাইরেরটা দেখবে, আমি ভিতরেরটা। তুমি জান, কোথায় পাঁচফোড়ন রয়েছে?’’ ছবির শেষে অবশ্য দেখানো হয়েছে, ওই প্রৌঢ়া বাইরের কাজও করছেন। ছবির পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘নারী-পুরুষ কেউ নির্দিষ্ট ভূমিকা নিয়ে জন্মায় না। বাঁচতে গেলে সকলের সব কাজ করা প্রয়োজন। সন্তানকে বড় করার সময়েই বাবা-মায়ের সেই শিক্ষা দেওয়া উচিত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cooking Kitchen Bombay High Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE